জানলে না গো অসম্মত, বাইরে বাইরে যেমনই হই
ভিতর থেকে আমিও ঠিক, তোমার মতো, তোমার মতো!
Wednesday 8 April 2020
তেজ- জয় গোস্বামী
তিনবার মরি যদি দুইবার জলে আর একবার
আগুনে স্বয়ং মৃত্যু হই
হই, যদি একবার তাকে পাই বুকে তবে ওই বক্ষে
ঢুকে গিয়ে আজীবন দুগ্ধ হয়ে থাকি
দুগ্ধ দিয়ে মারো, শুভ্র , বক্ষ চেপে মারো , তোর
মাথা মুখে চুলে ব্রহ্মতেজ মাখামাখি
এক জন্ম- তারাপদ রায়
অনেকদিন দেখা হবে না
তারপর একদিন দেখা হবে।
দুজনেই দুজনকে বলবো,
‘অনেকদিন দেখা হয় নি’।
এইভাবে যাবে দিনের পর দিন
বৎসরের পর বৎসর।
তারপর একদিন হয়ত জানা যাবে
বা হয়ত জানা যাবে না,
যে তোমার সঙ্গে আমার
অথবা আমার সঙ্গে তোমার
আর দেখা হবে না।
দোল : শান্তিনিকেতন- জয় গোস্বামী
১
বকুল শাখা পারুল শাখা
তাকাও কেন আমার দিকে?
মিথ্যে জীবন কাটলো আমার
ছাই লিখে আর ভস্ম লিখে-
কী করে আজ আবীর দেবো
তোমাদের ঐ বান্ধবীকে!
২
শান্ত বলে জানতে আমায়?
কলঙ্কহীন, শুদ্ধ বলে?
কিন্তু আমি নরক থেকে
সাঁতরে এলাম
তখন আমার শরীর থেকে
গরম কাদা গড়িয়ে পড়ছে
রক্ত-কাদা
হঠাৎ তোমায় দেখতে পেলাম
বালিকাদের গানের দলে
সত্যি কিছু লুকোচ্ছি না।
প্রাচীন তপোবনের ধারে
তোমার বাড়ি
কখন যাবো? - ঘুম পাচ্ছে-
বলো কখন মুখ রাখবো
তোমার কোলে!
বারণ করবে?
Tuesday 7 April 2020
মনে পড়ে- মহাদেব সাহা
এখন শুধু মনে পড়ে আর মনে পড়ে
মনে পড়ে মেঘ, মনে পড়ে চাঁদ,
জলের ধারা কেমন ছিলো-
সেসব কথাই মনে পড়ে;
এখন শুধু মনে পড়ে, নদীর কথা মনে পড়ে,
তোমার কথা মনে পড়ে,
এখন এই গভীর রাতে মনে পড়ে
তোমার মুখ, তোমার ছায়া,
তোমার বাড়ির ভেতর-মহল,
তোমার উঠোন, সন্ধ্যাতারা
এখন শুধু মনে পড়ে, তোমার কথা মনে পড়ে;
তোমার কথা মনে পড়ে
অনেক কথা মনে পড়ে,
এখন শুধু মনে পড়ে, এখন শুধু মনে পড়ে;
এখন শুধু মনে পড়ে আর মনে পড়ে
আকাশে মেঘ থেকে থেকে
এখন বুঝি বৃষ্টি ঝরে।
Saturday 4 April 2020
আর কোনোদিন হইনি এমন মর্মাহত – মহাদেব সাহা
এর আগে আর কোনোদিন আমি
হইনি এমন মর্মাহত
যেদিন তোমার চোখে প্রথম দেখেছি আমি জল,
অকস্মাৎ মনে হলো নিভে গেলো সব পৃথিবীর আলো
গোলাপবাগান সব হয়ে গেলো রুক্ষ কাঁটাবন।
সত্যি এর আগে আর কোনোদিন আমি
মর্মাহত হইনি এমন
সত্যি এর আগে আর কোনোদিন আমি
মর্মাহত হইনি এমন
যেদিন প্রথম পথে দেখলাম অনাথ কিশোর এক
ক্ষুধায় কাতর কেঁদে মরে,
তখনই আমার মনে হলো পৃথিবীতে কোথাও
তেমন আর সুখ কিছু নেই
ফুলের দোকানগুলি হয়ে গেছে অস্ত্রের গুদাম।
আমি আর কোনোদিন মর্মাহত হইনি এমন
যেদিন প্রথম দেখি
ইতিহাসের প্রতিটি পৃষ্ঠায় রক্ত লেগে আছে,
যেদিন প্রথম সবুজ বৃক্ষের দিকে চেয়ে দেখলাম
সেখানে লুকিয়ে আছে বিষধর সাপ, নদীর গভীরে
চোখ ফেলে দেখি এই জলে দূষণের বিষ, হাঙর-কুমির
তখনই দুহাতে ঢেকে মুখ বুঝলাম কতোখানি দুঃখী
এই কাছের পৃথিবী।
যেদিন প্রথম আমি আকাশের দিকে চেয়ে দেখলাম
মেঘে বজ্র, ক্রূর ঘূর্ণিঝড়
অরণ্যে ভীষণ সব পশু, লোকালয়ে খুনী আততায়ী
তখনই আমার মনে হলো পৃথিবীর আলো অস্তমিত।
এর আগে আমি আর কোনদিন মর্মাহত হইনি এমন
যেদিন প্রথম শুনি প্রেমিক অক্লেশে বসিয়েছে ছুরি প্রেমিকার বুকে
তখন বুঝেছি পৃথিবীতে দুঃখ ছাড়া চাষবাস হবে না কিছুই।
এর আগে কোনোদিন এমন হইনি মর্মাহত
যেদিন বৃক্ষের কাছে গিয়ে দেখলাম রক্ত ঝরে বৃক্ষের শরীরে
নদীর নিকটে গিয়ে দেখি নেই তার বুকে এতোটুকু তৃষ্ণারও জল
তখনই বুঝেছি কতোটা নির্দয় হতে পারে এই ভালোবাসার পৃথিবী।
সত্যি এর আগে আর কোনোদিন আমি হইনি এমন মর্মাহত
যেদিন দেখেও তুমি চোখ তুলে ফিরে তাকালে না।
পালক- শঙ্খ ঘোষ
সবকিছু মুছে নেওয়া এই রাত্রি তোমার সমান।
সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি পড়ে। কখনো-কখনো
কাছে দূরে জ্বলে ওঠে ফসফরাস। কিছুরই কোথাও
ক্ষান্তি নেই। প্রবাহ চলেছে শুধু তোমারই মতন
একা একা, তোমারই মতন এত বিকারবিহীন।
যখনই তোমার কথা ভাবি তবু, সমস্ত আঘাত
পালকের মতো এসে বুকের ওপরে হাত রাখে
যদিও জানি যে তুমি কোনোদিনই চাওনি আমাকে।
আড়ালে– শঙ্খ ঘোষ
দুপুরে রুক্ষ গাছের পাতার
কোমলতাগুলি হারালে-
তোমাকে বকব, ভীষণ বকব
আড়ালে ।
যখন যা চাই তখুনি তা চাই ।
তা যদি না হবে তাহলে বাঁচাই
মিথ্যে, আমার সকল আশায়
নিয়মেরা যদি নিয়ম শাসায়
দগ্ধ হাওয়ার কৃপণ আঙুলে-
তাহলে শুকনো জীবনের মূলে
বিশ্বাস নেই, সে জীবন ছাই!
মেঘের কোমল করুণ দুপুর
সূর্যে আঙুল বাড়ালে-
তোমাকে বকব, ভীষণ বকব
আড়ালে ।।
নৌকাডুবি- অমিতাভ দাশগুপ্ত
সরলের মধ্যে আছে কত মারাত্মক প্রতারণা,
যখন তা জানা যায়–
বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে।
ঐ গ্রীক নাক নিয়ে বিনয়ে সন্নত
যে-যুবক বসেছে সামনে,
নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে কত তীব্র আর্সেনিক,
যখন তা বোঝা যায়–
সারা দেহ নীল হয়ে গেছে।
নীলের কাঙাল তুমি?
নদী দ্যাখো, সাঁতারে যেয়ো না,
ওর বুকে কমপক্ষে
গোটাকুড়ি নৌকাডুবি আছে।
মনে মনে বহুদূর চলে গেছি- শক্তি চট্টোপাধ্যায়
মনে মনে বহুদূর চলে গেছি –
যেখান থেকে ফিরতে হলে আরো একবার জন্মাতে হয়
জন্মেই হাঁটতে হয়
হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে
একসময় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে পৌঁছুতে পারি
পথ তো একটা নয় –
তবু, সবগুলোই ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে শুরু আর শেষের কাছে বাঁধা
নদীর দু – প্রান্তের মূল
একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূণ্য
দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোরেন –
দুটো জন্মই লাগে
মনে মনে দুটো জন্মই লাগে।
তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরো বেশি ভালোবেসে ফেলি- মহাদেব সাহা
তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরো বেশি
ভালোবেসে ফেলি
তোমাকে ছাড়াতে গিয়ে আরো
বেশি গভীরে জড়াই,
যতোই তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই
দূরে
ততোই তোমার হাতে বন্দি হয়ে পড়ি,
তোমাকে এড়াতে গেলে এভাবেই
আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যাই
এভাবেই সম্পূর্ণ আড়ষ্ট হয়ে পড়ি;
তোমাকে ছাড়াতে গেলে আরো ক্রমশ
জড়িয়ে যাই আমি
আমার কিছুই আর করার থাকে না।
তুমি এভাবেই বেঁধে ফেলো যদি দূরে
যেতে চাই
যদি ডুবে যেতে চাই
তুমি দুহাতে জাগাও।
এমন সাধ্য কী আছে তোমার চোখের
সামান্য আড়াল হই,
দুই হাত দূরে যাই
যেখানেই যেতে চাই সেখানেই
বিছিয়ে রেখেছো ডালপালা,
তোমাকে কি অতিক্রম করা কখনও সম্ভব
তুমি সমুদ্রের চেয়েও সমুদ্র
আকাশের চেয়েও আকাশ তুমি আমার
ভেতরে জেগে আছো।
তোমাকে ভুলতে চেয়ে তাই আরো
বেশি ভালোবেসে ফেলি,
তোমাকে ঠেলতে গিয়ে দূরে
আরো কাছে টেনে নেই
যতোই তোমার কাছ
থেকে আমি দূরে যেতে চাই
ততো মিশে যাই নিঃশ্বাসে
প্রশ্বাসে,
ততোই তোমার আমি হয়ে পড়ি ছায়ার
মতন;
কোনোদিকে যাওয়ার আর একটুও
জায়গা থাকে না
তুমিই জড়িয়ে রাখো তোমার কাঁটায়।
তোমাকে ছাড়তে গিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে
আরো জড়িয়েছি
তোমাকে ভুলতে গিয়ে আরো
ভালোবেসেছি তোমাকে।
কে চায় তোমাকে পেলে- মহাদেব সাহা
বলো না তোমাকে পেলে কোন মূর্খ অর্থ-পদ চায়
বলো কে চায় তোমাকে ফেলে স্বর্ণসিংহাসন
জয়ের শিরোপা আর খ্যাতির সম্মান,
কে চায় সোনার খনি তোমার বুকের এই স্বর্ণচাঁপা পেলে?
তোমার স্বীকৃতি পেলে কে চায় মঞ্চের মালা
কে চায় তাহলে আর মানপত্র তোমার হাতের চিঠি পেলে,
তোমার স্নেহের ছায়া পেলে বলো কে চায় বৃক্ষের ছায়া
তোমার শুশ্রূষা পেলে কে চায় সুস্থতার ছাড়পত্র বলো,
বলো না তোমাকে পেলে কোন মূর্খ চায় শ্রেষ্ঠ পদ
কে চায় তাহলে বলো স্বীকৃতি বা মিথ্যা সমর্থন,
তোমার প্রশ্রয় পেলে কে চায় লোকের করুণা
বলো কে চায় তোমাকে ফেলে স্বর্ণমুদ্রা কিংবা রাজ্যপাট?
বলো না তোমাকে পেলে কোন মূর্খ অন্য কিছু চায়,
কে আর তোমার বুকে স্থান পেলে অন্যখানে যায়!
রঙবুদ্বুদ- রণজিৎ দাশ
ঝাঁকে ঝাঁকে চিঠি উড়িয়ে দিয়েছি তোমার চতুর্দিকে
ফু দিয়ে যেভাবে বালক ওড়ায় রঙবুদ্বুদ, এবং
নিজেই খুশিতে হাততালি দেয়, মশগুল চোখে হাসে।
পৃথিবীতে শুধু বুদ্বুদ-ই জানে বিচ্ছুরণের জাদু-
আপাতত তাই বালক বুঝেছে, সাবানফেনার পিছল
তাকে চিনিয়েছে স্কুল পালানোর অন্ধনতুন গলি
আমি তো চিনেছি তারও থেকে বেশি, জেনেছি কঠিন প্রিজম
শাদা আলোরেখা চুর চুর করে, নিহিত বর্ণমালা
তোমার শরীরে কেন ফুটে ওঠে আলিঙ্গনের আগে;
জেনেছি শরীরে কেন ফুটে ওঠে আলিঙ্গনের আগে;
জেনেছি তোমাকে - শাদা আলোরেখা, তুমিই ভ্রান্তি,
তোমারই বর্ণমালা
দেখেছি তোমার চুম্বনছবি শস্যে ও গানে, দেশি থিয়েটারে,
মানুষের বোকা ঠোঁটে
আমি-ও সকল চিঠিতে লিখেছি 'চুম্বন দাও, আলজিভ', তুমি
এত আর্তিকে অবহেলা করে গোপনে কেবল পালিয়ে গিয়েছো দূরে
যেখানে অজ্ঞ বালক ওড়ায় রঙবুদ্বুদ, ভাবে-
পৃথিবীতে শুধু বুদ্বুদ-ই জানে বিচ্ছুরণের মায়া
সামান্য কবিতা- ভাস্কর চক্রবর্তী ।
ঝড়-বাতাসের দিনে আবার তোমার সঙ্গে দেখা!
আবার তোমার সঙ্গে কথা!
আবার তোমার সঙ্গে গান ।
এরকম মনে হয় কোনোদিন যখন জীবন খানখান ।
(কৃত্তিবাস ১৪-০১-১৯৮২)