Saturday 25 July 2020

মায়া- শঙ্খ ঘোষ

নিঃসঙ্গ পাথরের গায়ে গড়িয়ে নামছে ক্ষীণ জলরেখা
তার অবলীলাক্রম দেখতে দেখতে মনে পড়ে
এ-রকমই হবার কথা ছিল

শূন্যে পাক খেতে খেতে ঝরে পড়ছে অনাথপাতা
তার উদাসীনতা দেখতে দেখতে মনে পড়ে
এ-রকমই হবার কথা ছিল

ঘাসের ওপর দিয়ে খরগোসের হালকা দৌড়
তার মসৃণতা দেখতে দেখতে মনে পড়ে
এ-রকমই হবার কথা ছিল

মাটি তার বুক পেতে সবই নেবে বলে স্থির হয়ে আছে
ভাঙা পাঁচিলের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বিকেলে
সমস্তই দেখি

অথচ তোমার জন্য মায়া আজও জটিলতাময়।

মীরাদি- বিজয়া মুখোপাধ্যায়

মীরাদি,
তুমি যদি সুন্দরী নও তো সে কে।
খাতা দেখছ বসে
শেষ বিকেলের রোদ দেয়ালে ছড়ানো
তোমার গালে গ্রিলের ছায়া পড়েছে
ইচ্ছে করছে
আমার হৃদয় বেটে মিশিয়ে দিই
ওই গালে
কপালে চিবুকে।
মীরাদি, তোমার
যেটুকু প্রকাশ্যে দেখি -
বিষাদের চন্দনে নিলীন,
আমাকে একান্তে বলো
অন্তরালে আরও কি সুগন্ধ আছে।
কার জন্য ব্রতবদ্ধ তুমি এতকাল
সে কি অন্ধ পাষাণপ্রতিমা,
বলো তার নামপরিচয়
পাথর ঝরাব আমি।
কিন্তু তারপর
তোমার চন্দন যদি ফুরোয় মীরাদি -
ফুরোবেই,
তখন আমার দিন কাটবে কী করে।

আজ- স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

সারাদিন আজ বৃষ্টি আসুক পাখি
ভেজা গাছেদের ডানায় বসুক ঘুম
আমিও নাহয় তোমার দু চোখে রাখি
মেঘ জমা কোনও পাহাড়ের মরসুম

তুমিও কোথাও  আলো ছায়া বেঁচে থাকো
মেঘ পিঠে নিয়ে আমিও বেরই ট্রাম
বড় গাছেদের গোপনে পালক রাখো
শহরে ওড়াও নরম গোলাপি খাম

সাদা কাগজের মনমরা আলো ভাসে
বুকের শহর বহুদিন ভাঙাচোরা
প্যাস্টেল রঙে কারা যেন ফিরে আসে...
বিগত জন্মে ছেড়ে গিয়েছিল ওরা!

তুমিও আমায় ছেড়ে গেলে বৈশাখে
এখন শ্রাবণ নির্জন পথে ঋণ
গলাচেরা পাখি কাকে যে এমন ডাকে
আজকে তোমার একলা থাকার দিন

অসমাপ্ত- স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

অন্ধকারের আরেকটি নাম শব্দ
তোমার শহরে ভীড় করে আসে আয়না
ঝলসানো কিছু ট্রাম লাইন পড়ে থাকল
তোমার মতোন তারা কেউ উড়ে যায় না

গুমটিতে একা ক্লান্ত ভিখারী গান গায়
বৃষ্টি মাথায় রিক্সাওয়ালার চেষ্টা
থেকে আমি রোজ ভাত দিয়ে মালা গাঁথলাম
যদিও গল্পে মিল হচ্ছে না শেষটায়

বিচ্ছেদ জুড়ে সারা দিন জল ঝরছে
মেঘ বেঁচে থাকে... গড়িয়াহাটায় ঘুম চোখ
নিয়ে উঠে দেখি আমার শহর শূন্য
হাসি মুখে তুমি আমার মৃত্যু গুনছ

বারবার তবু ফিরে আসবার গল্প
সাদা পাতা জুড়ে বেঁচে ওঠবার চেষ্টা
তুমি আসবে না। তুমি ফিরবে না। সব ঠিক
আমিও ডাইরি খোলা রেখে দেব শেষটা...

তারে বলে দিও- মাহমুদুল হাসান

তারে বলে দিও,
ফুল, ফাঁসি কিংবা অস্ত্রের প্রয়োজন নেই,
সে যে আমারে নির্দয়ের মতো অচেনা করে দিলো,
সেই নিদারুণ সুখ- এক মৃতদেহ লুকিয়ে রেখেছে মনে।

Friday 24 July 2020

ভালবাসা- তসলিমা নাসরিন

ভালবাসা পেলে কেবল বেগুন ভর্তা, দুটো লংকা চটকে ভাত
ফুটপাতে রাত
তবু অন্য এক আনন্দ হয় জেতার।

ভালবাসা পেলে
দু'আঙুলের ভেতর জীবন নিয়ে চমৎকার ফোঁকা যায়।
বুকের মধ্যে হায়!
বিনা তারে বেজে ওঠে অলৌকিক সেতার।

Tuesday 21 July 2020

পুজো - স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

আমার যা কিছু, আজ শেষ হয়ে এল
অন্ধের থেকে জোৎস্নাকে ধার করি
কোথায় কে যেন উঁচু করে টিপ পরে!
মাথা নিচু করে সময় পেরোয় ঘড়ি

আকাশে আবার পুজোর বৃষ্টি আসে
প্যান্ডেলে আসে রাত জাগবার চোখ
ফুটপাথে হাঁটে তোমার প্রেমিক যত
তাঁদের দু হাতে আজ কাশফুল হোক

পৃথিবীর শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমি
তোমার পুজোকে নিজের শরৎ ভাবি
এ শহর ক্রমে বাঁশের কেল্লা হল
চুম্বন হল বোনাসে নতুন দাবি

দূর থেকে এল বন্ধুর মতো অটো
শপিং-এ তোমার মনে এল সোনা-মাটি
আঙুলে জড়িয়ে কবেকার মেঘমালা
বকুল জমায় অন্ধ কলকাতাটি

আমিও অন্ধ, বিশ্বাস করো তুমি
হাতের স্পর্শে কী কঠিন লাগে চেনা
আকাশ কপালে উঁচু করে চাঁদ পরে
দেখলে, তোমার কিছু মনে পড়বে না।

আকাশপ্রদীপ- স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

আলোর শহর চমকে উঠল অন্ধকারে
আসতে আসতে বৃদ্ধ হল গাছের পাতা
জং ধরা ট্রাম কোথায় যেন আনমনা আজ
হারিয়ে গেল তোমার দেওয়া অঙ্ক খাতা

তুমিও কোথাও হারিয়ে গেছ, আর আসো না।
আয়না-কোণায় ঘুমিয়ে থাকে মনমরা টিপ
শূন্য ঘরে পর্দা ওড়ে, বই জমে যায়...
বন্ধু আমার বুকের ভেতর একলা ব-দ্বীপ

সব তো আছে। তবুও কেন কিচ্ছুটি নেই?
আতসবাজির আলোয় কেন রাত কাটে না?
একলা পাগল ঘুমিয়ে থাকে পথের পাশে...
তার দু চোখের স্বপ্নগুলো ভীষণ চেনা

বাদবাকি সব ক্লান্ত ঋতুর মেরুন শহর
যার পাশে রোজ বইতে থাকে বৃদ্ধা নদী
এই শহরের কোথাও আছো - মনকে বোঝাই -
অন্ধকারে তাই তো জ্বলে আকাশপ্রদীপ

কাঠের বাড়ি- স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

কাঠের বাড়ি কাঠের বাড়ি
জঙ্গলে যায় একলা গাড়ি
বুকের মধ্যে রাত

আঙুল ধরে পাতলা নদী
সাঁকোর উপর সপ্তপদী
হাতের ওপর হাত

ছাড়িয়ে নিয়ে উধাও তুমি
জঙ্গলে আজ মরুভূমির
ভীষণ উল্কাপাত

কাঠের বাড়ি কাঠের বাড়ি
তোমায় ছাড়া ওই আনাড়ীর
সকল কিস্তি মাত

দিন কেটে যায় রাতের মতো
সন্ধে কাটে অসংযত
অতল গিরিখাত

প্রদীপ হাতে অন্ধকারে
আর কতদিন হাঁটতে পারে
মনখারাপের ধাত...

কাঠের বাড়ি কাঠের বাড়ি
আমিও জেনো আগুন পারি...

পুড়িয়ে দিলাম হাত...

স্মরণজিৎ

অন্ধ আমার জীবন জুড়ে রাত্রি একা নামে
তোমার বাড়ির মাথায় এসে কাদের আকাশ থামে?
কাদের শহর চমকে ওঠে তোমার ধ্রুবতারায়
কোথায় কারা ভিজলো, যখন বৃষ্টি তোমার পাড়া
সাজিয়ে তোলে বর্ষাতি আর একলা বকুল দিয়ে?
তোমার মুখের হলুদ আভা নিজের পিঠে নিয়ে
বন্ধু নামের বিন্দু যেন আলোর মতো ভাসে
তোমার কথা ভাবলে আমার জোনাক মনে আসে!

আলোর গন্ধ- স্মরণজিৎ

বহু বহু জন্মের ওপার থেকে যেন ভেসে আসছে শব্দ । যেন বহুদিন পর নির্জন গুহামুখ ফাটিয়ে বেরিয়ে আসছে ঝর্ণা । মেঘ থেকে যেন বহুদিন পর নেমে আসছে বৃষ্টি ।
'কেমন আছিস ?'
কেমন থাকে প্রিয় মানুষকে ছেড়ে থাকা মানুষ? ঘুমের মধ্যে পাহাড়ি পথে মিলিয়ে যাওয়া সাইকেল যে আসলে মিলিয়ে যায় না । শরীরের ভিতর সেই রোগা সাইকেলের দাগ বয়ে বেড়ানো মানুষ কেমন থাকে? কতটা কষ্ট পেলে সে একলা হয়ে যায়?
(আলোর গন্ধ)

অলিখিত-স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

দীর্ঘদিন তোমাকে দেখিনি
স্পর্শ করিনি আরও দীর্ঘ সময়
চারিদিকে কে যেন ঝুলিয়ে দিয়েছে কালো পর্দা
কে যেন বলেছে চুম্বন বন্ধ থাকবে আগামী দু হাজার বছর
শুধু প্রজাপতি উড়বে শূন্য রেল ইয়ার্ডে সারাদিন

আর আমি সব কিছুর থেকে সরে, পিছিয়ে
হাতে তুলে নিই যুদ্ধের কোনও বই
সুড়ঙ্গে বসে ভাবি, আরও একটু পড়িজ
আরও একটু রুটির টুকরো, বেকড বিনস্ আর শুকনো মাংস
হলদে হয়ে যাওয়া সাদা কালো ছবি, রূপোর লকেট,
রুমালে ফুটিয়ে তোলা নাম!
ভাবি, এমন যুদ্ধের মাঝে
বহু বহুকাল আমাদের আর দেখা হবে না
শুধু মনখারাপ রঙের রোদ উঠবে পাড়ায়,
হাওয়া দেবে শূন্য পথে
বৃথা যাবে সমস্ত বকুল, গন্ধরাজ

এখন নিরুপায় সুড়ঙ্গ থেকে কল্পনা করে নিই তোমার চোখ,
কল্পনা করি,
টেবল ল্যাম্পের আলোয় মাথা ঝুঁকিয়ে পড়ছ কোনও বই।
আর ভাবি,
এখনও কি স্নান সেরে তুমি জল দাও টবে? পাখি আসে?
কাঠের পুতুল দেখে মনে পড়ে কিছু, কখনও!

ইচ্ছে হয়, চিঠিতে লিখি —
আজ সারাদিন মনখারাপ, বাঙ্কারের ধুলোয় তুমি তুমি গন্ধ!
পুরোনো দিনের মতো লিখি —
'দীর্ঘদিন তোমারে দেখি নাই,
এ শূন্যতা পূরণ করিবে কে প্রিয়তমা!'

লিখি না

জীবনের পাশ থেকে- ভাস্কর চক্রবর্তী

ভালোবাসা হয়তো বা তোমাকে বুঝেছি
উৎকট নির্দয়তা তোমার সঙ্গেও দেখা না হলে বলো তো
জীবন কীভাবে আমি বুঝতাম জীবন ?

(কবিতাংশ)

যৎসামান্য - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

লুকিয়ে রেখো না কোনো গোপন সিন্দুকে কিংবা লিখো না দলিলে
না দিলে থাকে না কিছু, ভালোবাসা ডুবে যায় স্বখাত সলিলে!

(কবিতাংশ)