Sunday 26 July 2020

বিশ্বাস- অরণি বসু

হাসতে হাসতে তুমি আমার হাত ধরো
হাসতে হাসতে আমি তোমার হাত ধরি
তবু চোখে জল কেন?

পুড়িয়ে পুড়িয়ে মৃতপ্রায় করে নেমে এসেছে
আকাশ উপুড় করা বৃষ্টি।
তবু চোখে জল? তোমার? আমার?

নিশিদিন সঙ্গীতবিহীন তুচ্ছতায় ভরা...

লাবণ্যের কাছে এসো আজ করজোড়ে বসে থাকি,
অনন্তর কাছ থেকে চেয়ে আনি একবাটি বিশ্বাস।

ডুব- জয়াশিস ঘোষ

আলোর দুষ্প্রাপ্যতায় তোমাকে মনে পড়ে।

মনে পড়ে জলের অন্ধকারে তুমি হাত ধরতে চেয়েছিলে
জ্বরে আমার মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। বিঠোভেন
বাজাচ্ছিলেন আশ্চর্য সিম্ফনি

অন্ধকার ভেঙে ভেঙে আমার মুখে ভরে দিচ্ছিলে
ওষুধ ভেবেছি
তাই ক্ষত থেকে ছিঁড়ে ফেলেছি জোনাকির পাখনা

এই দেহতাপ, যতই কবিতা মনে হয়
আসলে
অন্ধকারে ডুবে থাকা জুন মাস। স্নায়ুছেঁড়া দূরত্বে
খেলা করে প্রিয় পিছুটান

আলো কমে এলে দেখি লালারসে মুছে গেছে
                                              হত্যার প্রতিটি প্রমাণ

দ্বা সুপর্ণা- শঙ্খ ঘোষ

'কেমন করে পারো এমন স্বাভাবিক আর স্বাদু আহার
সব জায়গায় মানিয়ে যাও কিছুই তোমার নিজস্ব নয়
কেমন করে পারো?
নষ্ট তুমি নষ্ট তোমার আলগা শোভা বুকের বাহার
সমস্ত ফল ঠোঁটে জ্বালাও সবার সঙ্গে সমান প্রণয়
কেমন করে পারো?'

'নষ্ট আমি কিছুই আমার নিজস্ব নয় ; ডালে-ডালে
পাতায়-পাতায় স্বাদু আহার বিষ অথবা বাঁচার আগুন
ধরে ব্যাপক মাটি--
দীর্ঘতর বট, এমন জটিলঝুরি সমকালীন
সব জায়গায় থাকি, আমার
অন্য একটি পাখি কেবল আড়াল করে রাখি।'

সন্দেহ- অরণি বসু

তুমি হয়তো অন্য কাউকে ভালোবাসো, ভালোবাসতেই পারো--
সেটা তেমন কোনো সমস্যা নয়,
সমস্যা এই যে,
গরমকালে আমি ল্যাম্পোস্টের আড়ালে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকি
                                        তোমার অভিসারের সম্ভাব্য পথে,
শীতকালে র‍্যাপার মুড়ি দিয়ে অনুসরণ করি তোমায়।
গুজবে নড়ে হাওয়া, হাওয়ায় লাগে আগুন--
আগুনে আমি নিজেকে পোড়াই, তোমাকে পোড়াই আর

ধিক ধিক করে জ্বলতে থাকে আমাদের পৃথিবী।

সিল্যুয়েট ৪- জয়াশিস ঘোষ

প্রতিবার হাসপাতালে এলে আমি অন্ধ হয়ে যাই।
এত আলো আমাকে অমর করে তোলে। চারধারের
কান্নাধ্বনির মাঝে একরোখা এসরাজের শব্দ শুনি।
অথচ এই সময় আমার তোমাকে ছুঁয়ে থাকার কথা!
পালক হয়ে যাই। ওই জেদী মেয়েটার কপাল থেকে
ঘুরে আসি।
সেই মেয়েটা, মৃতদেহ ছেড়ে যে উঠে যায়নি
বৃষ্টিতে....

জল- অরণি বসু

তোমার বুকের ভিতর যতটা আগুন আছে
আমার ভিতরে ততটা জল নেই আজও।
কীভাবে জুড়াই তোমাকে-
কীভাবে শান্তি দিতে পারি-
ভাবতে ভাবতে রাস্তায় নেমে আসি,
পথে পথে খুঁজে বেড়াই জল।

শুধু তোমার পাশে পাশে থাকব বলে।

বোকা মানুষের চিঠি ৪- জয়াশিস ঘোষ

শহরে উদাসী হাওয়া।  মনের ভেতর শিরশির
কত কী বলেছে কানে, প্রেমিকেরা জন্মবধির

তোমার চোখের নীচে অসংখ্য কবিতার বাস
স্নান সেরে কাছে আসো আমার বিষাদবিলাস

যতবার কাছে যাই তোমাকে নতুন করে দেখি
এমন হাসির কাছে পৃথিবীর সব সুখ মেকী

রুক্ষ শীতের রাতে দরজায় বেঁধে নাও খিল
জেনেছ কার নামে বেজেছে গোপনীয় তিল?

একটু আগুন ঘিরে বসে আছে চার পাঁচ লোক
সন্ধের ফাঁকা বাসে বাড়ি ফেরে বেহালাবাদক

সামান্য আঁখিপাত শীতের সন্ধে দিয়ে কেনা
আমি যদি চাতক হই, তুমিও কি জল দেবে না?

অবৈধ- অরণি বসু

আমার জন্যে নয়, ওই মোমবাতি জ্বলেছিল অন্য কারও জন্যে
আমি ঘটনাচক্রে তার কাছাকাছি এসে উত্তাপ নিয়েছি।

আমার জন্যে নয়, ওই মোমবাতি জ্বলেছিল অন্য কারও জন্যে
আমি সন্তর্পণে আমার মুখে তার আলো মাখিয়ে নিয়েছি।

টুকরো জয়াশিস

*তাকে দায়সারা ভাবিনি কখনও
শুধু শেকলে বেঁধেছি তার দায়
স্পর্শ ছিঁড়ে গেলে কতটা অসুখ বোঝা যায়!

*বহুকাল কথা নেই। অস্ফুটে  গলে গেছে মোমও
যাকে তুমি ভালোবাসো, তার কাছে ভেঙেছ কখনও?

*আমাদের কথা নেই। আমাদের কথারা ভেসেছে
এ শহরে ভেজে তারা, যারা একবার ভালোবেসেছে

*নিছক কাঁচের টিপ। টেবিলে ছড়ানো থোকা স্মৃতি
বৃষ্টি প্রবল হলে ফেলে চলে যাওয়াটাই রীতি...

*সিল্যুয়েট ১

পাথুরে জমিতে
হোঁচট খাবো
'তুমি'র খোঁজে আমি আমরণ ভিজে যাবো
সম্পর্কের কাছে রেখে যাবো বেহায়া বটগাছ..
(কবিতাংশ)

*চুম্বন

দৌড়ে এসো! ওড়াও এলো চুল
তারে তারে জড়িয়ে গেছে গাছ
আমার ঠোঁটে রাখতে পারো ভুল
অথবা ঐ কঠিন ভ্রূর ভাঁজ!
********
হাতের ভেতরে শক্ত করে হাত
ঠোঁটের ওপর আছড়ে পড়ুক শোকে
চুমুবিহীন শহর নিপাত যাক
কালকে যেন গল্প করে লোকে!

(কবিতাংশ)

সন্ধ্যে- জয়াশিস ঘোষ

এ মেঘেরও নিজস্ব দিন ছিল আগে

তোমায় বলিনি চুল খুলে নাচলে অপার্থিব হয়ে যাও
গোপনে সারস দেখেছি, মরালগ্রীবাটি
পায়ের নূপুর খুলে বলেছিলে
'কেন একটুও যত্ন কর না নিজের?'

এ মেঘ নিজের স্বপ্ন থেকে ঝরে যাবে
ঘুমের ছাঁটে বন্ধ করে দেবে জানালা
বিষণ্ণতায় আলো খুঁজে দেবে
                                                         ডাকনাম।

বলতে পারিনি,  যেটুকু

যত্ন করতে পারলে তোমার হতাম...

মেঘমল্লার- জয়াশিস ঘোষ

তুমি তখন অল্পদিনই। নতুন বন্ধু। প্রস্তাবে না
হরিণচোখের ভেতর কেমন ছলছলেভাব চাঁদের মতন
ঘুম আসেনি। আমি ছিলাম বিষাদপ্রেমী। ঘামে নরম
হাত বাড়ালাম, বন্ধু হবে? দেখেছিলাম বৃষ্টিদানা।

অচেনা লোক। কয়েকটা দিন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট ঝুলেই ছিল
নাগরদোলায়। রবীন্দ্রনাথ মুচকি হাসেন। কালবোশেখী
আমি তোমার চুলের ফাঁকে দারুচিনির গন্ধ মাখি
শহর যখন লন্ডভন্ড। আমের মুকুল। পড়ল শিলও

ধীরে ধীরে বাড়ল জোয়ার। সকাল দুপুর কাব্যকথা
'কী খেয়েছ?' 'চায়ের প্যানটা পুড়েই গেল'।'বলব না যাও!
সেই যেদিনে বৃষ্টি হল অনেকদূরে, একসাথে তাও -
আমার হাতে যন্ত্রণা তাই তোমার মাথায় ভীষণ ব্যথা

ভালোবাসি, বলতে লাগে? হাইওয়েতে লরির আলো
আমি তখন প্রবল নেশায় যেমন ছিল সারা শহর
বুকের ভেতর উথাল পাথাল। তোমার তখন প্রচন্ড জ্বর
উল্টে গেল মরিচদানি। রাতের ট্রেনে মেঘ পাঠালো।

প্রথম দেখা। শাড়ির পাড়ে বিঁধেই থাকে চুরির কাঁটা
'দূরেই থাকো!' সবাই যেন তাকিয়ে আছে কঠিন চোখে
ঘামতে ঘামতে ভিজেই গেল হাতের মুঠো। কাটল নখে
ছিঁড়ল শাড়ি।প্রথম ছোঁয়ায় জল জমে যায় পদ্মপাতায়

রইলো পড়ে কাজের হিসেব, বসটা শালা জিরাফমুখো
আবার কবে হচ্ছে দেখা? কাচের চুড়ি, হাতিবাগান
'প্রহর শেষের আলোয় রাঙা' ইলশেগুড়ি চায়ের দোকান
অন্ধকারে কোণার সিটে ঠোঁট ফুলানো দুঃখ, সুখও

আলোর বেণু বাজায় যখন বীরেনবাবু, শিউলিবাতাস
পার ছাপিয়ে ভাসল নদী। উথাল পাথাল ভীষণ ঝড়ে
অষ্টমী ভোর। ম্যাডক্স স্কোয়ার। দুটো শালিখ ঝগড়া করে
বিষম খেল। বন্ধ ঘরে প্রবল রাগে ছিঁড়েছি কাশ!

ফুরিয়ে যায় গল্পগাথা। দূরে কোথাও পুড়ছে আলো
সাইকেলে সে বাঁক ঘুরেছে। ডাকবাক্সে পড়ল তালা
চুল বাঁধোনি। পায়ের তলায় ফোস্কা গলে ভীষণ জ্বালা
'পালিয়ে যাবি?' অনেক দূরের ছোট্ট স্টেশন ডাক পাঠালো।

পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা তখন বাসগুমটির পেছন দিকে
এদিক ওদিক তাকিয়ে ভীরু শালিখ ঠোঁটে মেঘমল্লার
আংটি, সিঁদুর কিছুই তো নেই! ভরসা কেবল বিসমিল্লা
এমন করে হয় কি বিয়ে? সাক্ষী বলতে বৃষ্টি বিকেল…

শীতের বাতাস শহর জুড়ে। লাল সোয়েটার। শুকনো ঠোঁটে
বোরোলিনের ভরসা পেলে থাকতে পারি।  সত্যি বলো?
এই জীবনের আর কটা দিন নদীর মত সঙ্গে চলো
নীরবতায় শব্দ বেশি। শিশিরভেজা বুকের ভেতর পদ্ম ফোটে।

তুমি তখন অনেকদিনের। ধোঁয়ার ভেতর বাঁধলে ঘুড়ি
শহর ঠোঁটে রঙ মেখেছে। কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, অশোক
পরের জন্মে সারস হবো। হাতের মুঠোয় ছলছলে চোখ
ফোন বেজে যায়। কিসের দেরী? বেখেয়ালে কাচের চুড়ি

ভাঙলো যখন। দৌড়ে এলে। জল পাড়িয়ে। হলুদ শাড়ি
সেই যেখানে তোমায় ছুঁয়ে কেঁদেছিলাম। বৃষ্টি প্রবল
অনেক গল্প বলার আছে। ধারের খাতায় দু ফোঁটা জল

এ জন্মে তো ঘর হল না
                           পরের জন্মে তোমার সাথে থাকতে পারি?

বোকা মানুষের চিঠি ১৫- জয়াশিস ঘোষ

একদিন বেখেয়ালে  তাকাবে আমার দিকে

যদিও তোমার চোখের সামনে
সাধারণ পালকের মত পড়ে আছি
যে পাখির, সে ভুলেও গেছে একদিন
ঘর না পাওয়া চিঠি , নামহীন

তুমি তুলে নেবে। গুঁজে নেবে চুলে
একদিন এই খয়েরি মফস্বলের সমস্ত ভুলে
প্রলেপ দেবে তুঁতে সালোয়ার
সেদিন যদি দুনিয়ার ভিড় থেকে আলাদা করে আমার
চোখ পড়ে নিতে পারো

দেখবে
সন্ধে, তোমার চুলের মত গাঢ়

সমুদ্রের তীরে এক নাবিক বসে আছে
যে প্রতিদিন বাড়ি ফেরার সময়                 
একটা চিঠি বোতলে ভরে ভাসিয়ে দেয়

খাদ- জয়াশিস ঘোষ

মনের ভেতর জ্যোৎস্না আসে, চুল খুলেছ অকস্মাৎ
পাহাড় থেকে গড়ায় কথা। পা বাড়ালেই গভীর খাদ

তোমার হাতে রাগ তুলে দিই, এক ফুরালে অন্য দি
কেউ বলেনি মধ্যরাতে আজ পৃথিবীর জন্ম দিন

এসব সবই স্বপ্নে পাওয়া পিছলে যাওয়ার উপাখ্যান
যাওয়ার দিনের বৃষ্টি, আদর, কান্না, আঘাত, শব্দ, গান

যে বা যারা বাসের খোঁজে একলা বসে, বাড়ছে স্রোত
তোমার আমার নীরবতায় অনেক আলোর জন্ম হোক

আলোর গায়ে আলতা লাগা।মেঘপিয়নের ভীষণ জ্বর
তোমায় ছোঁয়ার রাস্তাটুকু রেললাইনের সমান্তর

চুল খুলেছ নদীর পাশে, বাজ পড়ল অকস্মাৎ
বারান্দাতে আমরা দুজন। ঘরের ভেতর গভীর খাদ

ঝাঁপ- স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

বহুদূরে যেন কুয়াশা পড়েছে আজ
মাফলার এসে জড়িয়ে ধরেছে ঘুম
কলকাতা জুড়ে বৃষ্টি নামবে ঠিক
তোমার মনেও বকুলের মরশুম

সেই দেখে আমি ঝড় জলে একাকার
মানি ব্যাগে রাখি কুচি পাতাদের ঘাম
তুমি কি কোথাও ট্রাম থেকে নেমে গেলে?
আমিও নরকে সারারাত নামলাম

শুধু রয়ে গেল আলতো পিপারমিন্ট
ঠোঁট জুড়ে বাজে সন্ধের এপ্রিল
এলো হাওয়া লেগে মেলো হয়ে আসা দিন
তোমার চিবুকে ঈশ্বর আঁকে তিল

একলা শহর এঁকে রাখে সবকিছু
তুমিও ক্রমশ ফেলে দাও সব আমি
বাউণ্ডুলেরা তাই জড়ো হই মেঘে
ভাঙা কবিতায় তছনছ হয়ে নামি