Tuesday 28 July 2020

সম্পর্ক। পুরী ২০০১- অরণি বসু

অন্ধকারে সমুদ্রের মুখোমুখি এসে দাঁড়াই। একা।
বুঝতে পারি আপনিও এসে দাঁড়িয়েছেন পাশে।

সান্ধ্যকালীন বাজার এখন ধু ধু বালিয়াড়ি,
দূরে দিকচক্রবালের কাছে অস্পষ্ট এক আলোর সংকেত।
কোনো কথা হয় না, ইশারাও নেই কোনো,
শুধু বুঝতে পারি আমার সকল অন্ধকারে
                                    আপনি নীরবে এসে দাঁড়িয়েছেন পাশে।

সমস্ত ট্যুরিস্ট পায়ে পায়ে ঢুকে পড়েছে নিজস্ব ঠেকে।
আমাদের সমস্ত না-বলা কথা,
আমাদের সমস্ত না-গাওয়া গান মিশে যায়
                                       সমুদ্রের অনর্গল গর্জনের ভিতর।

ঝিলকিয়ে ওঠে ফসফরাসের মায়া,
কাছে আসে, দূরে চলে যায়।

কোয়ারান্টাইন ৯

যে সমস্ত সূঁচ বিঁধে আছে পৃথিবীর গায়ে
তাকে তুমি সরিয়ে ঘন পায়ে
আমার বিছানার ধারে এসে দাঁড়াও

যে কথা বলবে বলে, ভুলে গেছ
শুধু স্পর্শটুকু মনে আছে ঘুমের পাশেই
ফুল ফুটে আছে রোদের আশ্চর্য বাগানে
সেখানে অসুখ নেই

তবুও
আজন্মকাল ধরে দেখেছি
ঘুমের আগে কতটা ওষুধ হয়ে যাও!

Monday 27 July 2020

নৈহার- জয়াশিস ঘোষ

এভাবে কখনো বলিনি তোমায় আসতে
যতই রাত্রে ঝরে গেছে প্রিয় কান্না
কোনদিনও বলেছি কি ভালোবাসতে?

পায়ে লেখা আছে মাইলফলকে মৃত্যু
কে ভালো আছে- কেই বা পেরেছে জানতে
বিষাদে বিষাদে চমকে উঠেছে বিদ্যুৎ

তবু আসা যেত ফিরে ফিরে এই প্রান্তর
পাথরের মত বসে আছে। হুঁকো টানছে
তুমি ভুলে গেছ। আমিও এখন ক্লান্ত

রাতে ঘুম নেই। পোয়াতি নদীর কান্না
জ্বালিয়ে দিচ্ছে নদীপ্রান্তর, রতিসুখ
বুকের ভেতর হাত রেখেছিলে - 'আর না'!

আকাশে উঠেছে একফালি চাঁদ, কাস্তে
বৃষ্টি থেমেছে। ঘামে ভিজে আছে মরাঘাস
বলিনি কখনো। তবু যদি ভালোবাসতে!

ফিরে ফিরে- অরণি বসু

অনেক ভালোবাসার কথা বলেছি আমরা
অনেক রকম ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে এতদিন,
এবার, এসো, ঘুমের ট্যাবলেট বিষয়ে কিছু কথা বলা যাক।
********
আমরা কি এবার আবার ভালোবাসার দিকে ফিরবো?
আর, ধরো, যদি ফিরেই আসি তবে কি আবার সেই
                                           পুরনো দিনের গলায় কথা বলা যাবে?
আমরা কি আবার বৃষ্টির দিনে হাসতে হাসতে
                                             নেমে যেতে পারবো খোলা মাঠে?
এখন তো আমরা আর সহজে মুগ্ধ হই না,
এখন আমাদের ভালোবাসায় অনেক কাঁটা, বালি আর পিছুটান।

(কবিতাংশ)

বোকা মানুষের চিঠি ২

একটা ভীষণ সাধারণ সকালে তুমি আমার নাম করে
বিষম খাবে।  আমি বুকের ভেতর গামছা বেঁধে
সোজা নেমে যাব স্রোতের মুখোমুখি। এমন দিনে
গ্লকোমা কেটে গিয়ে বাবা রেডিওতে বিবিধ ভারতী চালিয়ে দেবে
নিবেদিতা সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে তুমি ওড়না ফেলে দেবে
আমার গা দিয়ে নেমে যাবে অপূর্ব শীত!

এরকম একটা সাধারণ দিনে আমি অরণ্যদেব হলে
তুমি কি পলাশফুল হবে না?

নীল দিগন্তে- জয়াশিস ঘোষ

একা মানুষ যখন ভয় পায়
তার সমস্ত হাড় মজ্জায়
ফোঁটায় ফোঁটায় ছড়িয়ে গেছে বিষ
তুমি আমার প্রেমের দাবী
আমি কলঙ্কেরও ভাগী
যদি ছায়ার মত জড়াও অহর্নিশ

তবু দেওয়ালে কান পাতি
আমার লুকানো বর্ষাতি
আলোর কাছে হেরেই গেছে ছায়া
তুমি বুকের ওপর শুয়ে
আছ সমস্ত ঢেউ ছুঁয়ে
তবু ঝিনুক গোনে সমুদ্দুরের মায়া

এমন একলা হওয়ার দিন
আলো ক্ষয়ে ক্ষয়েই ক্ষীণ
তোমার কেন চোখের কোণে জল?
আসুক দু কুল ছাপা ঝড়
আজ অনেক দিনের পর
ভাসিয়ে দেবো যা ছিল সম্বল

তবু শর্ত যদি দিলে
এই পলাশ ফাগুন মিলে
লাল রঙ ছড়াবে অভিমানের স্রোতে
আমার বন্ধ চোখের ঠাঁই
যা পাই পলকে হারাই
হাত ছাড়িয়ে বন্ধুরা সব ছোটে

একা মানুষ যখন কাঁদে
জল বিষাদ চাপে বাঁধে
দু চোখে আজ পেরিয়ে যাবো সাঁকো
আমি তোমার ভেতর মরে
যাবো আগের মত করে
যদি বসন্তে আজ আমার কাছে থাকো!

কে এসেছে- জয় গোস্বামী

এই আকাশের নীচে, এই জল মাটিতে কাদায়, খালি পায়ে
আমরা কয়েক পা এসো হাঁটি

দাঁড়ালে, দাঁড়িয়ে পড়তে পারো
যেতে ইচ্ছে করো যদি তোমার শরীর আর তোমার ঠিকানা
অপর কারোর কাছে যাক

এ-জল মাটির মধ্যে, এই আলপথে, এই দশ-বারো লাইন লেখায়
আমার হাঁটার পাশে তোমার পায়ের ছাপ থাক

(কবিতাংশ)

সরোদ বাজাতে জানলে- পূর্ণেন্দু পত্রী

আমার এমন কিছু দুঃখ আছে যার নাম
তিলক-কামোদ
এমন কিছু স্মৃতি যা সিন্ধুভৈরবী
জয়জয়ন্তীর মত বহু ক্ষত
রয়ে গেছে ভিতরে দেয়ালে
কিছু কিছু অভিমান
ইমন-কল্যাণ।
সরোদ বাজাতে জানলে বড় ভাল
হতো।
পুরুষ কীভাবে কাঁদে সে-ই শুধু জানে।
কার্পেট সাজানো প্রিয়
অন্তঃপুরে ঢুকে গেছে জল।
মুহুর্মুহু নৌকোডুবি, ভেসে যায়
বিরুদ্ধ নোঙর।
পৃথিবীর যাবতীয় প্রেমের
সপ্তডিঙা ডুবছে যেখানে
সেখানে নারীর মত পদ্ম ফুটে থাকে।
জল হাসে, জলতার চুড়িপরা হাতে,
নর্তকীর মত নেচে ঘুরে ঘুরে ঘাগরার
ছোবলে
সবকিছু কেড়ে নেয়, কেড়ে নিয়ে ফের
ভরে দেয়
বাসি-হয়ে-যাওয়া বুকে পদ্মগন্ধ,
প্রকাণ্ড উদ্যান।
এই অপরূপ ধ্বংস, মরচে-পড়া ঘরের-
দোরে চাঁপা রঙে এই চুনকাম
দরবারী কানাড়া এরই নাম ?
সরোদ বাজাতে জানলে বড় ভাল
হতো।
পুরুষ কীভাবে বাঁচে সে-ই শুধু জানে।

Sunday 26 July 2020

শুভরাত্রি- লেখা মেঘ -৯ - জয় গোস্বামী

Send me the words 'Good Night' to put under my pillow.

প্রেমিকাকে অনুনয় করেছিলে, মৃত্যুর এক বছর আগে
একফালি কাগজে শুধু 'শুভরাত্রি' লিখে
যেন সে পাঠায়, তুমি
বালিশের নীচে নিয়ে শোবে।

এখন রাত্রির দিকে তাকালেই দেখি
তোমার ফুসফুস থেকে জ্বলন্ত কয়লারা বার হয়ে
আকাশে আকাশে জ্বলছে!
জ্যোৎস্নারা ঠিকরে পড়ছে সকল গাছের পাতা থেকে

শুধু 'শুভরাত্রি' লেখা এক খণ্ড মেঘ
চাঁদের তলায় এসে থেমে গেল।
ও বোধহয় জানে
তোমার ঘুমন্ত দেহ শুয়ে আছে চাঁদে মাথা রেখে!

আষাঢ়- জয়াশিস ঘোষ

হঠাৎই সন্ধে হল। বৃষ্টিতে ভেসেছে প্রশ্রয়
যে কথা কাছের ছিল তাকেও দূরের মনে হয়

রাস্তায় লোক নেই। অভিমান জমেছে কাজলে
আদরের অধিকার মুঠো খুলে ভাসিয়েছি জলে

আলোর হদিশ নেই। আলোকবর্ষ খুঁজে ফেরা
তোমার চুলের থেকে আকাশও নিয়েছে আন্ধেরা

ধুয়ে যাক বালিয়াড়ি, ঠান্ডা কফির চোরা দাগ
এমন অমোঘ দিনে বেপরোয়া ভেঙে যাক বাঁধ

হিসেব বকেয়া থাক।  আমাদের  পায়ে পায়ে ঢেউ
কথার বরফ কাঁধে চুপিসারে পালিয়েছে কেউ

আমাদের কথা নেই,  আমাদের কথারা ভেসেছে
শহরে তারাই ভেজে যারা একবার ভালোবেসেছে

চিহ্ননাম- জয় গোস্বামী

আমি তো কাঠের মতো ভালো লোক।
ঘুণধরা সম্ভব আমাতে।
আমি তো লোহার মতো স্থাণু লোক
মরচে পড়ে যায় সহজেই।

অথচ তুমি তো দেহ
দান করেছিলে এই হাতে।
বলেছিলে, সুরক্ষিতা,
গর্ভসঞ্চারের ভয় নেই।

কেন ভয় ছিল না তোমার?
কেন তুমি রাখলে না
গোপনে আমার চিহ্ন, নাম?
কেউ জানতে পারত না,
শুধু আমরা দু'জনে জানতাম!
কত দেরি হয়ে গেল,
এখন সময় নেই আর।

(কবিতাংশ)

বিশ্বাস- অরণি বসু

হাসতে হাসতে তুমি আমার হাত ধরো
হাসতে হাসতে আমি তোমার হাত ধরি
তবু চোখে জল কেন?

পুড়িয়ে পুড়িয়ে মৃতপ্রায় করে নেমে এসেছে
আকাশ উপুড় করা বৃষ্টি।
তবু চোখে জল? তোমার? আমার?

নিশিদিন সঙ্গীতবিহীন তুচ্ছতায় ভরা...

লাবণ্যের কাছে এসো আজ করজোড়ে বসে থাকি,
অনন্তর কাছ থেকে চেয়ে আনি একবাটি বিশ্বাস।

ডুব- জয়াশিস ঘোষ

আলোর দুষ্প্রাপ্যতায় তোমাকে মনে পড়ে।

মনে পড়ে জলের অন্ধকারে তুমি হাত ধরতে চেয়েছিলে
জ্বরে আমার মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। বিঠোভেন
বাজাচ্ছিলেন আশ্চর্য সিম্ফনি

অন্ধকার ভেঙে ভেঙে আমার মুখে ভরে দিচ্ছিলে
ওষুধ ভেবেছি
তাই ক্ষত থেকে ছিঁড়ে ফেলেছি জোনাকির পাখনা

এই দেহতাপ, যতই কবিতা মনে হয়
আসলে
অন্ধকারে ডুবে থাকা জুন মাস। স্নায়ুছেঁড়া দূরত্বে
খেলা করে প্রিয় পিছুটান

আলো কমে এলে দেখি লালারসে মুছে গেছে
                                              হত্যার প্রতিটি প্রমাণ

দ্বা সুপর্ণা- শঙ্খ ঘোষ

'কেমন করে পারো এমন স্বাভাবিক আর স্বাদু আহার
সব জায়গায় মানিয়ে যাও কিছুই তোমার নিজস্ব নয়
কেমন করে পারো?
নষ্ট তুমি নষ্ট তোমার আলগা শোভা বুকের বাহার
সমস্ত ফল ঠোঁটে জ্বালাও সবার সঙ্গে সমান প্রণয়
কেমন করে পারো?'

'নষ্ট আমি কিছুই আমার নিজস্ব নয় ; ডালে-ডালে
পাতায়-পাতায় স্বাদু আহার বিষ অথবা বাঁচার আগুন
ধরে ব্যাপক মাটি--
দীর্ঘতর বট, এমন জটিলঝুরি সমকালীন
সব জায়গায় থাকি, আমার
অন্য একটি পাখি কেবল আড়াল করে রাখি।'