Thursday 13 August 2020

পারাপার- অরবিন্দ গুহ

তোমার কাছে অনেক কিছু গোপন করে রাখি,
তুমি আমার মধ্যদিনের পাখি।
অসংশয়ে শুনি তোমার নানারকম স্বর,
তুমি আমার একা থাকার ঘর।

দিনের বেলা কাটাতে হয় কটু কাজের ভানে,
দু-চোখ আমি সজল করি কপট অভিমানে।
তোমারও চোখ সহসা জলময়
সফল হল আমার অভিনয়__
মাঘের শেষে বৃষ্টি নামে বাঙলাদেশের প্রাণে।

বৃষ্টি যদি নামে মাঘের শেষে,
বলতে পার কী হয় তবে দেশে?
জান না? হায় আমিই কি তা জানি?
তুমি আমার নিরবতা, তুমি আমার বাণী।

তুমি যখন ডোবাতে চাও, আমি তখন ভাসি;
দূরে সরাও, আমি তোমার বুকের কাছে আসি।
বন্ধ হয়, আবার খোলা দ্বার।
জীবন ভরে আমার পারাপার
করতে হবে। কেন যে আমি তোমাকে ভালোবাসি!

কেন এ রকম হয়?- শামসুর রাহমান

'কেন এ রকম হয়?'
-শামসুর রাহমান।

কেন এ রকম হয়? হবে? কেন তুমি অভিমানে
স্তব্ধ হয়ে যাবে? কেন এতক্ষণ করবে না ফোন?
আমার অসুবিধে নেই, টেলিফোনও কিছু বিগড়ে আছে।
এই যে মুহূর্তগুলি, ঘণ্টাগুলি আমাকে চিবিয়ে
খাচ্ছে হিংস্র বিড়ালের মতো, তুমি কি বোঝো না? হায়,
এ বয়সে আমি আর কত কষ্ট পাব? কী আমার
অপরাধ, বুঝতে অক্ষম। গাছ হয়ে জন্মানোই
ছিল ঢের ভালো, বিষাদের লেশমাত্র থাকত না।

তোমাকে উপেক্ষা করি, এই মতো ভাবনায় তুমি
সম্প্রতি কাতর নাকি! অথচ আমি যে সারাক্ষণ
জপছি তোমাকে, এমন কী স্বপ্নের ঘোরেও করি
উচ্চারণ ভালোবাসা তোমার উদ্দেশে। আলিঙ্গনে
বাঁধি তোমাকেই মাঠে, নদীতীরে, পাহাড়ে, জঙ্গলে।
কীভাবে তোমার রোষে, প্রিয়তমা, অস্তমিত হবে?

Wednesday 12 August 2020

মেঘ- নবনীতা দেবসেন

সেই মেয়েটা, সে হতে চায় পাখি
আজকে ভাবে ঈগলপাখি হবো
কালকে ভাবে সিন্ধুসারস হই-

সেই মেয়েটা, মেয়ে ভীষণ জেদী
জেদ ধরেছে, সমুদ্র আকাশে,
দুই ডানা তার মেলবে দু'জায়গাতেই

কিন্তু আগে জল ছোঁবে না বাতাস?
ভাবতে ভাবতে নিজেই হোলো সমুদ্দুরের হাওয়া
নিজেই হোলো হাওয়ার বুকে ঢেউয়ের নোনা চুমু

সেই মেয়েটা, মেয়ে ভীষণ জেদী
শেষ অবধি জেদ রেখেছে ঠিক-
মেয়ে হয়েছে ঈশানকোণের মেঘ...

যেদিন,সেইদিন- ভাস্কর চক্রবর্তী

দিনগুলো কিলবিলিয়ে যেভাবে যাচ্ছে
মনে হচ্ছে
তেমন দিনও এবার চলে আসতে পারে
যেদিন কবিতাও আর ভালো লাগবে না
না-পড়তে, না-লিখতে।

কী করবো সেদিন? কী করবো?

আলো- প্রবুদ্ধসুন্দর কর

সন্ধ্যা নেমে এলে সমূহ মনোবেদনা নিয়ে জ্বলে ওঠে একটি নক্ষত্র
বিষাদস্পৃষ্ট তোমার মুখ
কোনো একদিন যদি স্পষ্ট হয়ে ওঠে
বোঝা যাবে, সেই নক্ষত্রের আলো
পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে, সামান্য আগে।

জয়পরাজয়- অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

তুমি আমার ভ্রূযুগ পর্যন্ত তুষার ছেয়ে দিয়ে বলেছ:
'এইবার বানাও রোদ্দুর'

আমি তোমার চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে গিয়ে
যেই জ্বেলে দিয়েছি রোদ্দুর

তোমার দু'চোখে দেখি কমনীয় ঘৃণা -
তুমি পরাজিত নাকি আমি জয়ী বুঝতে পারি না!

আমি তোকে ভালবাসি- বেণু দত্তরায়

একদিন বিশ্বাস করতে ভাল লাগবে
এই যে আমি বলছি
              তোকে ভালবাসি

একদিন বিশ্বাস করতে ভাল লাগবে

আজ তোর কাছে আকাশ এসেছে
সমস্ত পৃথিবী তোকে ঘিরে জানতে চায়
তোকে
           সার দিয়ে দাঁড়িয়েছে
                                আনন্দচন্দ্রিমা

এ-উৎসবে আমি আমন্ত্রিত নই
আমি কিছু চাইতে আসিনি
এই যে এই এককোণে দাঁড়িয়েছি
দু-সেকেন্ড দাঁড়িয়ে দেখে চলে যাব
আর মনে-মনে বলব, ভালবাসি

আর কিছুই বুঝবিনে
চন্দ্রমার দিন শেষ হলে
অন্ধকার কিছু বিষণ্ণতা রেখে যায়

আর তার মধ্যে ডুবে
একদিন বিশ্বাস করতে ভাল লাগবে
এই যে এই আমি বলছি
                          তোকে ভালবাসি

প্রার্থী- পূর্ণেন্দু পত্রী

আমাকে একটু আলোক দাও
রোদ মাতাল ভোর
একটু দাও মুক্ত হাওয়া
রুদ্ধশ্বাস এ বুকে,
আমি কি দেব,কি দিতে পারি
তোমাকে শক্তিমান
তোমাকে দিই কখানা ভাঙা
পাঁজরে যত জ্বালা।
আমাকে একটু বর্ষা দাও
দুমুঠো কাটি ধান
একটু দাও ফাগুনে- রোদ
আঁধার- ঘোর ঘরে
আমি কি দেব,কি দিতে পারি
তোমাকে মহাব্রতী
তোমাকে দিই কোটরাগত
দুচোখে যত দাহ।
আমাকে একটু শক্তি দাও
শালের মতো ঋজু
একটু দাও সুখের ছোঁয়া
পাথর- খসা মনে
আমি কি দেব,কি দিতে পারি
তোমাকে মহাপ্রাণ
তোমাকে দিই ঘৃণার ক্ষতে
রক্তজবার ঝাড়।
আমাকে একটু শান্তি দাও
ফুলের মতো স্বাদ
একটু দাও অবসরের
উদয়মুখী আশা
আমি কি দেব,কি দিতে পারি
তোমাকে জ্যোতির্ময়
তোমাকে দিই আকাশ- মাটি
কাঁপানো কন্ঠস্বর।

শোনো- কবিতা সিংহ

অমল,
এই নিরভিমান বিকালে একা
অবনত মস্তকে হেঁটে যাই
মাঝে মাঝে হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে আসে পাতা
বসন্ত বৃক্ষের থেকে পরিত্যক্ত হলুদশটিত

এভাবেই ক্রমে ক্রমে বেশি করে পারি
যত জানি
যত কাছে সরে আসি তোমার সকাশে
অমল এই বৈশাখসন্ধ্যায়, সূর্যের মহিমা দেখে
মাথা শুধু নত হয় আসে।

অনুরাধা নক্ষত্রের জাতক ও তাঁর রনলেখাগুলি- বিশ্বজিৎ দেব


ক)
রেলব্রীজ হতে চেয়ে হাত পা ছুঁড়েছি আমিও, দুদিকে দোটানা। জীবন্ত ও শবের মাঝামাঝি চমকে উঠেছে নয়নতারার ঝিকি,একটি শুন্য পৃষ্ঠায় এসে আকাশ নেমেছে , মাটির যমজ-
একটি অসহায় হাতপাখা নিজে থেকেই নড়ে উঠেছে সামারের দীর্ঘ খুশিতে।
গান হয়ে বসে আছে একটি কাঠের হারমোনিয়াম।চারদিকে কি ভীষণ বিবাহতান্ডব!

খ)
চলো পালাই, শেষ ভূখণ্ডে যেখানে জমাট
বাঁধছে বরফ, জলের ব্যথার সাথে মিশে
যাচ্ছে মাটি। চলো তার প্রান্তিকে পা ঝুলিয়ে বসে মদ খেতে যাই, নীলের সফেন
থেকে ছেনে তুলি আকাশের ফাঁকি তারাদের নামে লিখে ফেলি
নভো সিরিয়াল,জঙ্গলে ঠাসা পৃথিবীর
ঘুনের কনসার্ট ....

গ)
আমাকে শায়িত রেখে সব বিচ্ছেদ জুড়ে দেবে বলে এভাবেই তৈরি হচ্ছে
টানা রেলব্রীজ,ঝমঝম অনুবাদ,আয়রনের ঘোর, মরচের সমুহ বিরাগ।
এসবই পূর্বসুচিত, দুদিকের বিপুল তফাত এঁকে রাখা জল, সাত সিঁড়ি সর্বনাম অস্থির ক্ষয়,আকাশ ডাকলে কবে দৌড়ে যাবে ব্ল্যাকহোল, আয় আয় খোঁকা
মাসিপিসি ঘুম!

ঘ)
কার যতিচিহ্ন অবধি আমিও লিখেছি তাঁর
রনলেখাগুলি, আমিও বেঁধেছি টানা ক্রেন
দুদিকের ভুল বোঝাবুঝি! তারাদের আলোকশুন্য রাতে কেউ জানতে পারেনা এই খুনোখুনি,লুটিয়ে পড়ার আগে কিরকম শ্বাস নিচ্ছে চিরপরাজিত ছৌ
কাঁপা কাঁপা রিখটার থেকে নেমে যাচ্ছে
হতাহত নক্ষত্রের ছাই....

ঙ)
এসবের থেকে দুরে
গ্রামের একমাত্র মানতের থানে লোকে জড়ো হয় এই বিস্ময়ে, স্তুপিকৃত জবামালা
ঘোর কৃষ্ণপক্ষ রাতে ঝরে পড়ে নিরক্ত রোশনাই!

Tuesday 11 August 2020

Monday 10 August 2020

কোথাও কেউ-তসলিমা নাসরিন

কোথাও না কোথাও বসে ভাবছো আমাকে, আমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তোমার,
মনে মনে আমাকে দেখছো, কথা বলছো,
হাঁটছো আমার সঙ্গে, হাত ধরছো,
হাসছো।
এমন যখন ভাবি, এত একা আমি, আমার একা লাগে না,
ঘাসগুলোকে আগের চেয়ে আরও সবুজ লাগে,
গোলাপকে আরও লাল,
স্যাঁতস্যাঁতে দিনগুলোকেও মনে হয় ঝলমলে,
কোথাও না কোথাও আমার জন্য কেউ আছে
এই ভাবনাটি আমাকে নির্ভাবনা দেয়,
ঘোর কালো দিনগুলোয় আলো দেয়,
আর যখন ওপরে ওপরে দেখাই যে পায়ের তলায় খুব মাটি আছে,
আসলে নেই, আসলে পা তলিয়ে যাচ্ছে, তখন মাটি দেয়।
যখন মনে হয় ভীষণ এক ঝড়ো হাওয়ায় উল্টে যাচ্ছি, যেন একশ শকুন আমার দিকে উড়ে
আসছে, হিংস্র হিংস্র মানুষ দৌড়ে আসছে আমাকে খুবলে খাবে — অসহায় আমিটিকে
ভাবনাটি নিরাপত্তা দেয়।
কেউ ফিরে তাকায় না, কেউ স্পর্শ করে না, ভালোবাসে না
দেখেও আমি যে ভেঙে পড়ি না, আমি যে ভেসে যাই না, আমি যে কেঁদে ভাসাই না–
সে তো তোমার কারণেই, কোথাও না কোথাও তুমি আছো বলে।
আছো, কোথাও আছো
যে কোনওদিন আমি ইচ্ছে করলে তোমাকে পেতে পারি,
এই ভাবনাটি তোমার কাছ থেকে দূরে রাখতে পারছে আমাকে,
আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারছে।

কাব্যগ্রন্থ ঃ কিছুক্ষণ থাকো

দ্বিধাগ্রস্ত অধিবাস- রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

পলেস্তারা খ'সে পড়া এই ঘরের দেয়াল, এইসব আসবাব
                                    এতো পরিচিত কেন!

কোনোদিন কি এখানে ছিলাম কোনো জন্মে
আমার অস্তিত্বকে ভালোবেসে কারো বিনিদ্র রাত কেটে যেতো
ললাটে আমার চুম্বন এঁকে কারো শুরু হতো প্রথম সকাল।
কোনোদিন কি আমার না-থাকায় কেউ এসে ছড়াতো বিলাপ
                                        নিশব্দ বাতাসের মতো---

(কবিতাংশ)
৩১.০৭.৭৬ (রাত্রি) মিঠেখালি মোংলা