Sunday 2 December 2018

যদি যেতে চাও- তসলিমা নাসরিন

যদি যেতে চাও, এভাবেই যেও--
ঠিক যেভাবে গেছ
ঠিক যেভাবে, আলগোছে, টের না পাই
দরজা আধখোলা রেখে
ফিরে আসবে ভেবে যেন কোনদিন খিল না দিই।
যেও, যেতেই যদি হয়-- দু চারটা কাপড় ভুল করে
আলনায় ফেলে-- এভাবেই
স্নানঘরে রেখে যেও তোয়ালে
এক জোড়া চপ্পল-- এভাবেই।
দমকা বাতাসও কড়া নাড়ে সময় সময়
কোনও কোনও রাতে এরকমও ভেবে নেব, বুঝি ফিরেছিলে
বেঘোরে ঘুমিয়েছিলাম বলে চলে গেছ।

যদি যেতে চাও
- তসলিমা নাসরিন

ব্যক্তিগত ব্যাপার- তসলিমা নাসরিন

ভুলে গেছো যাও,
এরকম ভুলে যে কেউ যেতে পারে,
এমন কোনও অসম্ভব কীর্তি তুমি করোনি,
ফিরে আর তাকিও না আমার দিকে,
আমার শূন্যতার দিকে।
আমি যেভাবেই আছি, যেভাবেই থাকি
এ আমার জীবন, তুমি এই
জীবনের দিকে আর করুণ করুণ চোখে
তাকিয়ে না কোনওদিন।
ভুলে গেছো যাও, বিনিময়ে আমি যদি
ভুলে না যাই তোমাকে, যেতে না পারি
সে আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার,
তুমি এই ব্যাপারটি নিয়ে ঘেঁটো না,
এ আমার জীবন, কার জন্য কাঁদি,
কাকে গোপনে ভালোবাসি জানতে চেও না।
ভুলে গেলে তো এই হয়, ছেড়ে চলে গেলে তো
এই-ই হয় — যার যার জীবনের মতো
যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপারও যার যার হয়ে ওঠে।
তুমি তো জানোই সব, জেনেও কেন বলো যে মাঝে মাঝে যেন খবর টবর দিই কেমন আছি!
আমার কেমন থাকায় তোমার
কীই বা যায় আসে!
যদি খবর দিই যে ভালো নেই,
যদি বলি তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে,
যদি বলি তোমার জন্য আমার মন কেমন করছে,
শরীর কেমন করছে!
তুমি তো আর ছুটে আসবে না
আমাকে ভালোবাসতে!
তবে কী লাভ জানিয়ে, কী লাভ জানিয়ে যে আমি অবশেষে সন্ন্যাসী হলাম!

ব্যক্তিগত ব্যাপার
- তসলিমা নাসরিন

আরও একজন- সৈয়দ শামসুল হক

যেখানেই যাও তুমি, যেখানেই যাও
সঙ্গে যায় আরো একজন;
যদিও অদূরে তবু তার দূরত্ব ভীষণ।
যেখানেই দৃষ্টি দাও, যেখানেই দাও
দৃষ্টি দেয় আরো একজন;
যদিও সুনীল তবু সেখানেই মেঘের গড়ন।
যাকেই যে কথা বলো, যাকেই যে কথা
শুনে যায় আরো একজন;
যদিও নিশ্চুপ তবু অবিরাম পদ্মার ভাঙন।
যেখানেই রাখো হাত, যেখানেই রাখো
রাখে হাত আরো একজন;
যদিও নিশ্চল তবু দ্রুত তার শিরায় স্পন্দন।
যখন শয্যায় তুমি, যখন শয্যায়
পাশে আছে আরো একজন;
যদিও ঘনিষ্ঠ তবু ঘুম কেড়ে নিয়েছে কখন।
তুমি কি দেখেছো তাকে ? চেনো তাকে ?
সচকিত মাঝে মাঝে তাই ?
তোমার সম্মুখে তবে আমি এসে আবার দাঁড়াই ?

আরও একজন
-সৈয়দ শামসুল হক

নিরুক্তি- সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

আমারে তুমি ভালবাসো না ব’লে,
দুঃখ আমি অবশ্যই পাই ;
কিন্তু তাতে বিষাদই শুধু আছে,
তাছাড়া কোন যাতনা, জ্বালা নাই ।।

জনমাবধি প্রণয়বিনিময়ে
অনেক বেলা হয়েছে অবসান ;
বেজেছে ফলে কেবলই বৃথা ব্যথা,
পারিনি কভু করিতে বরদান ।।

এ-ভুজমাঝে হাজার রূপবতী
আচম্বিতে প্রসাদ হারায়েছে ;
অমরা হতে দেবীরা সুধা এনে,
গরল নিয়ে নরকে চ’লে গেছে।।

অযুত নারী, তাদের প্রতিশোধে,
জাগায়ে লোভ হেনেছে অবহেলা ;
সাহারা,গোবি ছেয়েছে ভাঙা পণে,
মরমহিমা হয়েছে ছেলেখেলা ।।

অসূয়া বুকে করেছে মাতামাতি
ঝড়ের রাতে বিজুলিঝলাসম;
চিনেছি তাতে আপন নীচতারে,
টুটেছে মান, উঠেছে বেড়ে তম।।

মিলনে ক্ষুধা মিটেনি কোনও কালে ;
কামনা শেষে মিশেছে এসে কামে ।
অন্ধ আশা রুদ্র বিরহেরে
ভাববিলাসী করেছে পরিণামে ।।

হয়ত তাই তোমার অনাদরে
আজিকে আমি হই না বিচলিত ;
শিখেছি ঠেকে ব্যর্থ ভালোবাসা,
কালের কাছে অতনু পরাজিত ।।

হৃদয় তবু বিষাদে ভ’রে ওঠে
নিরুদ্দেশ শুন্যে যবে চাই ;
পাই না ভেবে শান্তিতে কি হবে,
সাধনাতে যে সিদ্ধি হেথা নাই।।

নন্দনের বদ্ধ দ্বার, জানি,
যাবে না খুলে তোমার করাঘাতে;
অমৃতযোগে প্রেতের কানাকানি ;
ঘুচাবে ভেদ তৃপ্তি-শোচনাতে ।।

তথাপি মিছে আত্মসমাহিতি ;
নিরাসক্তি আসক্তিরই ভেক ;
নাস্তি যার পৃষ্ঠে, পুরোভাগে,
সমান তার বিবেক, অবিবেক ।।

আত্মা সদা স্বগত,একা বটে,
তাই কি হেয় দেহের পরিচিতি?
থাক না তাতে তৃষিত অচিরতা,
বাকি যা-কিছু, সবই যে অনুমিতি ।।

নিরুক্তি
-সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

তুলনামূলক হাত- নির্মলেন্দু গুণ

তুমি যেখানেই স্পর্শ রাখো সেখানেই আমার শরীর৷
তোমার চুলের ধোয়া জল তুমি যেখানেই
খোঁপা ভেঙ্গে বিলাও মাটিকে;
আমি এসে পাতি হাত, জলভারে নতদেহ আর
চোখের সামগ্রী নিয়ে ফিরি ঘরে, অথবা ফিরি না ঘরে,
তোমার চতুর্দিকে শূন্যতাকে ভরে থেকে যাই৷
তুমি যেখানেই হাত রাখো, যেখানেই কান থেকে
খুলে রাখো দুল, কন্ঠ থেকে খুলে রাখো হার,
সেখানেই শরীর আমার হয়ে ওঠে রক্তজবা ফুল৷
তুমি যেখানেই ঠোঁট রাখো সেখানেই আমার চুম্বন
তোমার শরীর থেকে প্রবল অযত্নে ঝরে যায়৷
আমি পোকা হয়ে পিচুটির মতো
তোমার ঐ চোখের ছায়ায় প্রতিদিন খেলা করে যাই,
ভালোবেসে নিজেকে কাঁদাই৷
তুমি শাড়ির আঁচল দিয়ে আমাকে তাড়িয়ে দিলে
আমি রথ রেখে পথে এসে তোমারই দ্বৈরথে বসে থাকি
তোমার আশায়৷ তুমি যেখানেই হাত রাখো
আমার উদগ্রীব চিত্র থাকে সেখানেই৷
আমি যেখানেই হাত পাতি সেখানেই অসীম শূন্যতা, তুমি নেই৷

তুলনামূলক হাত
- নির্মলেন্দু গুণ

তরুণী সন্ত - হুমায়ূন আজাদ

যেখানে দাঁড়াও তুমি সেখানেই অপার্থিব আলো । 

তুমি হেটে যাচ্ছো,আমি বহু দূর থেকে দেখছি,
তোমার স্যান্ডেল থেকে পুঞ্জ পুঞ্জ জোনাকি শিখার মতো গলে পড়ছে আলো,
কংক্রিট,ধুলোবালি ,ঝড়াপাতা রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে অলৌকিক হীরে মুক্তো সোনা প্রবাল পান্নায়।
তোমার স্যান্ডেলের ছোঁয়ায় সোনা হয়ে যাওয়া এক টুকরো মাটি আমি সেই কবে থেকে বুকে বয়ে বেড়াচ্ছি দিনরাত।

যে দিকে তাকাও তুমি সেদিকেই গুচ্ছ গুচ্ছ আশ্চর্য গোলাপ।

একবার চোতমাসের প্রচন্ড দুপুরে তুমি দাঁড়ালে পথের পাশে
তোমার পেছনে একটি মরা গাছ হাড়ের মতো শুকনো ডাল জংধরা
পেরেকের মত সংখ্যাহীন কাঁটা ছাড়া কিছুই ছিল না তার।
তোমার আঁচল উড়ে গিয়ে যেই স্পর্শ করলো সেই মরা গরিব গাছকে
অমনি তার কাঁটা আর শুকনো ডাল ঢেকে দিয়ে 
থরে থরে ফুটে উঠলো লাল লাল আশ্চর্য্য গোলাপ।

যে দিকে ফেরাও মুখ সেদিকেই আবিভূর্ত অমল সুন্দর।

কলা ভবন থেকে বেরুচ্ছিলে তুমি-
হঠাৎ দুটো গুন্ডা, হয়তো তোমার সহপাঠী, হোন্ডায় চেপে এসে থামলো তোমার পাশে। তুমি ফেরালে মুখ ওদের কুৎসিত মুখের দিকে; আমি দেখলাম-ওদের ঘা আর দাগ ভরা মুখ নিমিষেই হয়ে উঠলো দেবদুতের মুখের মতোন জ্যোতির্ময়। 

যে দিকে তাকাও তুমি সে দিকেই অভাবিত অনন্ত কল্যাণ ।

বাসস্টপে পড়ে থাকা কুষ্ঠরোগীটির মুখের দিকে তুমি তাকিয়েছিলে একবার। তখন কুষ্ঠরোগীটিকে মনে হয়ে ছিলো ,
রূপসীর করতলে প'ড়ে আছে রজনীগন্ধার বৃষ্টি-ভেজা অমল পাপড়ি।

তুমি তো তাকাও সব দিকে;
শুধু তুমি আমার মুখের দিকে,
মানুষের দুরূহতম দুঃখের দিকে,
এক শতাব্দীতে
একবারো  ভুলেও তাকালে না।

তরুনী সন্ত
-হুমায়ুন আজাদ
(আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে)