Tuesday 13 October 2020

পরাজিত পদাবলী- আবুল হাসান

আমার বাহু বকুল ভেবে গ্রীবায় পরেছিলে
মনে কি পড়ে প্রশ্নহীন রাতের অভিসার?
অন্ধকারে আড়াল পেয়ে ওষ্ঠে তুলে নিলে
হঠাৎ গাঢ় চুম্বনের তীব্র দহনগুলি?

মনে কি পড়ে বলেছিলে এ পোড়া দেশে যদি
বিরহ ছাড়া কিচ্ছুতে নেই ভালোবাসার বোধি-
রাজ্য জুড়ে রাজার মতো কে আর থাকে কার
রাতের পথে সহজ হবে দিনের অভিসার?

হৃদয় আজ কুপিয়ে দেই বিচ্ছেদের চারায়
দোলাই তাতে মন চেতনা মনস্তাপের ফুল!
তোমার ইন্দ্রিয়ে তার সৌরভেরা হারায়
যখোন তুমি বাঁধতে বসো তোমার এলোচুল?

তোমার কাছে গিয়েছিলাম রাতে নদীর ঢেউ
তোমায় আমি পরিয়েছিলাম অঙ্গুরীয় মেয়ে

ভুল বুঝা সে মানুষ তাকে বোঝেনি আর কেউ
তুমি যেমন তোমার মতো বুঝতে চেয়েছিলে।

তার ইচ্ছায়- সিকদার আমিনুল হক

ঘুমিয়ে কাটলাে বেলা : যেই শুরু হলাে ফের রাত্রি
দেখি দূরে পর্বত আবার!
ক্রমশ বড়ােই হচ্ছে, যত নিচ্ছি চামড়ার গন্ধ...
উপচে পড়ে আমার খাবার।

সকল দিকেই আলাে। এত ফরসা। সাত দিকে শাদা... তাই তাে আদর করি চুল;
কিছু ত্রুটি ভালাে লাগে। স্বাস্থ্য, আয়ু কত দিন আর
চেটে খাবাে অবেলার ভুল!

স্মৃতির সম্বল জল, বাষ্প হয়ে ওড়ে না আকাশে
থাকে শুধু লেহনের তৃষ্ণা;
হে নগ্ন, এখানে আয়। সিল্কগুলি পরাবাে সকালে অকারণ যাতনা দিস না!

ভ্রষ্টপ্রেম- প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত

সে এসে দাঁড়ায় বুঝি আকাশের মতো,
তবু স্থির, আলোয় আনত
শরীরে কোথাও আমি চামেলি কি জুঁই
রাখি না কিছুই;

সে যদি হাওয়ায় সরে, জলে ভেসে যায়,
দাবানলে পোড়ে-
তার মৃতদেহে, নাকি স্মৃতির শরীর
ভীরুহাতে, চুপিচুপি ছুঁই।

Thursday 8 October 2020

বাউল- শঙ্খ ঘোষ

বলেছিলাম, তােমায় নিয়ে যাব অন্য দূরের দেশে
সেই কথাটা ভাবি,
জীবনের ওই সাতটা মায়া দুরে দুরে দৌড়ে বেড়ায়
সেই কথাটা ভাবি।
তাকিয়ে থাকে পৃথিবীটা, তােমার কাছে হার মেনে সে বাঁচবে কেমন ক'রে।
যেখানে যাও অতৃপ্তি আর তৃপ্তি দুটো জোড়ায়
জোড়ায় সদরে-অন্দরে।

উদাসিনী নও কিছুতে-বুঝতে পারি তােমার বুকে
অন্য কিছু আছে,
যন্ত্রণা তার পাকে পাকে হৃদয় খােলে, সে-খােলাটার অন্য মানে আছে।
ঘুমের মধ্যে দেখি আলাের ভরা-কুসুম নীলাংশুকে বাঁধতে পারে না, এ :
উঠেই দেখি কী বিচিত্র, একটি আঁচড় লাগেনি তার ভালােবাসার গায়ে।

বলেছিলাম তােমায় আমি ছড়িয়ে দেব দুর হাওয়াতে সেই কথাটা ভাবি।
তােমার বুকের অন্ধকারে সুখ বেজেছে মদির হাতে
সেই কথাটা ভাবি।

দুঃখ- অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

তবু কি আমার কথা বুঝেছিলে, বেনেবউ পাখি?
যদি বুঝতে পারতে
নারী হতে।

আমাকে বুঝতে পারা এতই সহজ?
কারুকেই বোঝা যায় নাকি!

শুধু বহে যায় বেলা, ঈশ্বর নিখোঁজ ;
কিংবা বুঝি এ-দুঃখ পোশাকি,
না-হলে কী করে আজও বেঁচে আছি রোজ,
বেনেবউ পাখি!

পান্থ- অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

মাঝে-মাঝে স্পষ্ট করে বলা দরকার
ঈশ্বর আছেন,
মগডালে-বসে-থাকা পাপিয়াকে আর
পর্যবসিত বস্তুপৃথিবীকে স্নান করাচ্ছেন।

মাঝে মাঝে স্পষ্ট করে বলা প্রয়োজন
তুমি যে আমার
সাধনার ধন,
তুমি চলে গেছ বলে আমাকে গাহন করাবার
কেউ নেই, যত্রতত্র সেরে নিই মধ্যাহ্নভোজন।।

তোমার যে হাতে- রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

তুমি যে হাতে স্বপ্ন সাজিয়ে গড়ো আপন পৃথিবী
                  আমার সে হাত নেই,
প্রতিবার তাই নত হয়ে আসি তোমার চোখের কাছে ।

ওই চোখ জানে কতোটা প্লাবনে ভেসেছে জীবন
কতোটা খরার খরতায় বুকে জ্বলেছে সবুজ মাটি,
নিশিদিন জুড়ে জেগে থাকা সেই ধ্বংসের স্মৃতি
                     নত হয়ে আসি তাতে ।

যে হাতে জড়ানো অমেয় সাহসে গড়েছো শব্দহীনতা
            আমার সে হাতে সে সাহস আজো নেই
প্রতিবার তাই নত হয়ে আসি তোমার পৃথিবী ছুঁয়ে ।

ফেরার সময় হয়ে গেছে বোলে সাজিয়েছি পাখা
জানি, পথ টেনে নিয়ে যাবে দুজনায় দুই প্রান্তে
কোনোদিন আর স্মৃতির সম্মুকে বিশ্বাস বেঁধে হবে না আসা
              ভুলে যাওয়া সত্যি হবে অন্য প্রয়োজনে ।

যদি শেষ বাঁশি বেজে থাকে বুকে
তবে একটি মুহূর্ত শুধু বিস্মৃতিবিহীন
একটি না বলা কথা এসে পোড়াক হৃদয়
                          নীল অনন্ত আগুনে ।

নির্দিষ্ট ব্যবধান- রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

তোমার থেকে আমার মাঝের
        ব্যবধান শুধু একটি রাত
        সুনির্দিষ্ট একটি দিন,
তোমার থেকে আমার মাঝের
        ব্যবধান শুধু একটি ঘর
        অলৌকিক এক শূন্যতা ।

তোমার থেকে আমার বুকের
        ব্যবধান এক করুন চাঁদ
        আগুন ঘষা আকাশটা,
তোমার থেকে আমার চোখের
ব্যবধান এক রম্য কাঁচ
        কালো ফ্রেমের ব্যর্থতা ।

তোমার থেকে আমার পথের
ব্যবধান এই বাতাসটুকু
        ঘৃন্যতম নিসর্গ,
তোমার থেকে আমার মাঝের
ব্যবধান ঐ নীল হাসি
       বিষন্নতার দুইটি ঠোঁট ।
তোমার থেকে আমার মাঝের
        ব্যবধান শুধু তুমি আমি,
অমীমাংসিত তিনটি হাত ।

Sunday 20 September 2020

অভিশাপ- শৈলেন হাজরা

অপমান আর অবহেলায় অনুভূতি মরেছে,
পৃথক হয়ে শিখেছি বাঁচতে শেখা-
নতুন ঘরে দক্ষ আমরা মানিয়ে নিতে,
মিল ছিলনা আমাদের ভাগ্যরেখায়।

একদিকে পড়ে শরীর। অন্যদিকে মন,
অন্তরেতে বাস অন্য এক পড়শীর-
ভালোবাসা অপরাধ। অভিশাপ ছিল আমাদের,
সবশেষে তাই রাতের ঘরে গুমরে মরছি।

তুমি এখন প্রহর গুনছ ফেরত পাওয়া ব্যস্ত দিনের,
সমান্তরাল পথ। প্রাক্তন আজ'ও আছে সুখে-
নিয়ম করে ফুল ফোটেনো আর সদ্য কুঁড়ির,
মৃত্যু আসার ঠিক আগে জড়িয়ে নিও নিথর বুকে।

Friday 18 September 2020

প্রেমের ক্ষমা - আবুল মকসুদ

যেমন চাঁদের জন্য চাই একটি আকাশ
তেম্নি হৃদয়ের জন্য নিঃসীম ভালবাসা,
ফসলের জন্য বন্ধ্যামাটিতে প্রয়োজন
শিল্পীর মতো তিতীষ্ণু এক চাষা;

সখী, চাঁদ যদি রাখো হাঁড়ির ভিতরে বন্দী
কেউ কি জানবে কত সীমাহীন তার প্রতিভা,
এ হৃদয় যদি কারো নাহি বাসে ভালো
তুমি বলো :  আহা কার কি তাতে ক্ষতি বা!

ভীষণ যে ক্ষতি বুঝবে না তুমি কোনোদিন,
বক্ষ তোমার বন্ধ্যামাটি কালো উপমা,
ভালোবাসা ছাড়া হৃদয় যে শুধু অর্থহীন
সেটাই বুঝতে তোমাকে করেছি প্রেমের ক্ষমা।

ভালবাসা যাযাবর- তরুণ চট্টোপাধ্যায়

ভালবাসা মানে এমন তো নয়, শুধু প্রেম প্রেম খেলা,
ভালবাসা মানে বাসনা-কুসুম একে একে ছিঁড়ে ফেলা।
ভালবাসা মানে এই নয় শুধু দাঁত দিয়ে মাড়ি কাটা,
ভালবাসা মানে কাঁটার ওপরে রক্তাভ হয়ে হাঁটা।
ভালবাসা মানে এই নয় শুধু রঙে রঙে হোলি খেলা,
ভালবাসা মানে স্বপ্ন অভ্রে হৃদয় রাঙিয়ে তোলা।
ভালবাসা মানে এই নয় শুধু প্রেমহীন মৈথুন,
ভালবাসা মানে লুকানো কবিতা মনে সেতারের ধুন।
ভালবাসা মানে এই নয় শুধু জ্যোৎস্নায় গান গাওয়া।
ভালবাসা মানে ফুলের মতন নিঃশেষে ঝরে যাওয়া।
ভালবাসা মানে এই নয় শুধু হাতে হাতখানি রাখা।
ভালবাসা মানে হৃদয় বেদনা মনের গভীরে ঢাকা।
ভালবাসা মানে শুধুই দুজন? বাকি আর সব পর?
ভালবাসা মানে সবাই আপন তুমি আমি যাযাবর।

টিয়া- বিকাশ গায়েন

যাকে ছেড়ে গিয়েছিলে তাচ্ছিল্য মাখিয়ে
সে কবেই ঠাঁই পেয়ে গেছে অন্যমনে।
তোমাকে না ভোলা তার চিরস্থায়ী হয়ে থাক
আজও তুমি ভেবে যাও অশ্রুর বিজনে।

ছেড়ে ছিলে যদি তবে কেন এত দ্বিধা ভুলে যেতে?
বিমুখ করার ছলে আসলে তুমিও তাকে
চেয়েছিলে পেতে।
সকলেই ভারে কাটে, কজনই বা ধারে!
নিরাপত্তা সুনিশ্চিত,
এইবার ঝুঁকি নিয়ে দেখা যেতে পারে?

শেষ কথা বলেছিলে, আরও কিছু ছিল তবে বাকি!
আকাশ পরিধি জুড়ে উড়ছে স্মৃতির টিয়াপাখি।

একটি কথার মৃত্যুবার্ষিকীতে- অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

তুমি যে বলেছিলে গোধূলি হলে
সহজ হবে তুমি আমার মতো,
নৌকো হবে সব পথের কাঁটা,
কীর্তিনাশা পথে নমিতা নদী!
গোধূলি হলো।

তুমি যে বলেছিলে রাত্রি হলে
মুখোশ খুলে দেবে বিভোর বিভা,
অহংকার ভুলে অরুন্ধতী
বশিষ্ঠের কোলে মূর্ছা যাবে!
রাত্রি হল।

তুমি জানলে না- প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়

যে-কোনও ছুতোয় আমি একদিন অভিমান করে
সব কিছু ছেড়ে চলে যাব,
তোমার ঘুমন্ত মুঠি তাই কি এভাবে ধরে রাখে
বসনের খুঁট? তুমি ভাবো,
দিগন্তের অন্ধকার হঠাৎ বন্ধুর মতো যদি অবিকল নাম ধরে
কোনওদিন ডাকে,
তুমি ফেরাবে আমাকে।

নিশি-পাওয়া মানুষেরা কত দূরে যায়? যেতে পারে?
আমি তারও চেয়ে বহু দূর
যোজন-যোজন পথ পার হয়ে যাই। রুক্ষ, অচেনা, কঠিন,
প্রতি রাত্রে অদ্ভুত বন্ধুর
দিগন্তের কাছাকাছি, দিগন্ত ছাড়িয়ে, শূন্য নির্জন আঁধারে
নিরালম্ব, আশ্রয়বিহীন।

তুমি জানলে না, কোনওদিন।