Thursday 2 April 2020

জ্বর- সৃজা ঘোষ

জ্বরকে চিরকালই আমার কেমন যেন এক মায়াবী অসুখ মনে হয়। পারদে পারদে জানান দিয়ে সে আসে অনতিবিলম্বে। আতিশয্যে নয়, গোপনে যেভাবে আসে প্রেম, যেভাবে আসে মরণ, যেভাবে আসে অভিমান...  কাঁচের মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট ফুটে ওঠে আগমনী৷ জ্বরের খবরে প্রিয়জনের মুখ ভার হয়, ফুরফুরে মেয়ে জ্বরে পটে থম মেরে যায়, এতকালের লুকিয়ে রাখা ব্যথা যা করতে পারেনি, জ্বর তা অনায়াসে পারে। আমি কাঁদিনা অথচ চোখ ছলছল করে! চোখ বন্ধ করতে পারি সহজে অথচ ঘুমোতে ইচ্ছে করে না! খেতে ইচ্ছে করে না! শুধু রাগ করতে ইচ্ছে হয়। তখন ভেতরে শীত, বাইরে আগুন গা। তখন বলে দিলেই ভাল, কিন্তু বলতে পারছি না। জ্বর আসে। যাদের ছোঁয়ার অধিকার নেই, তারা কতকিছু ভাবে আর যারা অনায়াস জোর খাটানোর মত আপন, তারা খালি কাজের ফাঁকে গাল কপাল ঘাড় ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে। গম্ভীর মুখে বলে ওঠে- ' মনে হচ্ছে ভোগাবে'। জ্বর এলে কেউ ছেড়ে যায় না, থার্মোমিটার নিয়ে আসে, গায়ে চাদর টেনে দেয়, সব আব্দার তখন আপনিই মঞ্জুর হয়ে যায়। প্রিয় বন্ধু বান্ধব ফোনে লেগে থাকতে চায়, আর যাদের জীবনে বিশেষ সংজ্ঞাহীন কেউ থাকে তারা নাকি বকে, অন্যদিনের চেয়ে কিছু বেশি ক্ষণ থাকে! তারা নাকি গান শোনায়! আগুন গা জড়িয়ে ধরে রূপকথার গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ায়- জ্বরের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে রাজপুত্তুর তুলে আনে এ পৃথিবীর সবচাইতে শীতল মাটি। সে মাটি রাজকন্যার জ্বোরো গায়ে লেপে দিলে তবে জ্বর সারে। পোড়া গা মন ঠান্ডা হয়। পায়ের পাতায় সাড় আসে।
জ্বরকে চিরকালই আমার খুব নরম বিষাদ মনে হয়। তার রঙে নীল, তার ঢঙে ছেলেমানুষী, পরণে অহংকার। তার আসায় যাওয়ায় কমায় বাড়ায় কারোর জেহাদ খাটে না, কেবল আদর খাটে।  তাই জ্বর এলে মাথা ধুইয়ে দিতে হয়, ভাত খাইয়ে দিতে হয়, মাঝে মাঝেই কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে যতটা সম্ভব নরম করে বলতে হয়- 'এই তো আছি', হাতের পাতায় পায়ের পাতায় ওম দিতে হয়, আড়ালে খোঁজ নিয়ে যেতে হয়, সে ঘুমিয়ে পড়লে সারারাত জেগে জেগে উঠে দেখতে হয়- জ্বর বাড়ল কিনা। জ্বর আসলে একরকম মদ। নেশা ধরায়৷ এ সময় বেশি বলতে ইচ্ছে করে না, কেউ গল্প শোনালে বেশ ভাললাগে। মেরে দিতে নয়, মরে যেতে ইচ্ছে করে।  ঘ্যানঘ্যান গুলোকে প্রশ্রয় দেবার কেউ থাকলে সেরে উঠতে ইচ্ছে করে। কষ্ট হলে চুপ করে থাকতে ইচ্ছে করে।  গল্প থামলে রাগ হয়, গান থামলে আরও। কেউ চলে যেতে চাইলেই চাদর সরিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। কেউ কাছে না থাকলেই ঠান্ডা জলে স্নান করে একটা বিপর্যয় ঘটাতে ইচ্ছে করে। তারপর জ্বর বাড়লে কিছু মনে থাকেনা। জ্বর সারলে তাকিয়ে দেখি মশারির মধ্যে রোদ ঢুকেছে। কেউ যেন হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাথায়, কেউ যেন বলছে- 'যাক বাবা, এবারের মত রক্ষে! '

জ্বর রক্ষে পায় না। সে হাওয়ায় হাওয়ায় থাকে। মাঝে মাঝে ফুরফুরে মেয়েদের গায়ে এসে বসে প্রজাপতির মত। প্রথমে গা ছ্যাক ছ্যাক করে, তারপর সে আসে সমারোহে। জ্বর এলে ক্লান্তিতে, ছেলেমানুষীতে মানুষকে আরও হাজারগুণ সুন্দর দেখায়। কি এক আলো নরম করে দেয় তার সমস্ত সামলে চলা। উষ্ণ চোখে ফুটে ওঠে অসুখে মোহময়ী এক  ঐতিহ্যবাহী ব্রহ্মকমল৷

তার অমন পাগল করা রূপ ভোলা যায় না। জ্বর হলে সরে যাওয়া নিয়ম। সবাই হাত রাখেনা কপালে। আর যারা ছোঁয়, যারা হাত রাখে, সাথে নিয়ে বাড়ি ফেরায়, ঘন্টায় ঘন্টায় খোঁজ নেয় থার্মোমিটার কি রিড দিচ্ছে, তারা পরবর্তী সবকটা জ্বরের অধ্যায়ে অসুখ সামলাতে আজীবনের মত থেকে যায়...

সবার সাথে জ্বর ভাগ করা যায় না। কারোর কারোর সাথে যায়। মা বাবার পর আমরা মেয়েরা সারাজীবন ধরে বোধহয় এই জ্বর ভাগ করার মানুষই খুজি।  🙂

চিঠি - সৃজা ঘোষ

তোমাকে প্রেম,

অথচ তুমি এলে ভাল হবে। আমার দোতলার ঘরটা এবার নতুন করে সাজাবো। লেখার জায়গায় ফ্লাওয়ার ভাস, কর্নার টেবিলে একটা হলুদ আলোর ল্যাম্পশেড, সোকেশে একটা সুগন্ধী মোম। প্রিয় জানলাগুলোর জন্য নতুন পর্দা কিনব। হাওয়ায় ওড়া, অবাধ্য, রঙীন ফুল আঁকা পর্দা... সারাদিন উড়বে সে। আমি বুঝব নতুন হাওয়া এলো আমার জন্যে...

তুমি এলে বাবার সেই কবেকার দেওয়া খালি পড়ে থাকা ডায়েরিটা সদ্য কিশোরীর মত ভরিয়ে ফেলব। একটা নতুন নিব পেন চাই কিন্তু। কাউকে ধরতেই দেব না আমার ডায়েরি। ভেতরের পাতায় যা ইচ্ছে, পেছনের পাতায় লুকোনো কাটাকুটি। আর ওপরে? গোটা গোটা হরফে লিখব 'গোপন'। শব্দটাকে ঘিরে দুটো জড়িয়ে যাওয়া লতা আঁকব...

ঠিক সময় ঘুমোবো তুমি এলে। অন্ধকার আমাকে মুখ ভেঙানোর আগেই আমি অন্ধকারকে ভেংচি কাটব। তোমার সাথে কথার ফাঁকে কখন চোখ লেগে আসবে, নিজেই জানব না। ঘুমের মধ্যে থেকে থেকে কেঁপে উঠবে না একজন। কেন বলোতো? তখন যে ভয়ের কিচ্ছু থাকবে না, ভোলার কিচ্ছু থাকবে না... লক্ষ্মী মেয়ে কাকে বলে জানো? ঠিক তেমন হবো আমি।

তুমি এলে অল্প সাজব। টিপ, দুল পরি না বলে আর শুনতে হবে না মায়ের বকাবকি। যে মেয়েটা সাজ বলতে শুধু ডার্কসার্কেল সামলানো কাজল বোঝে, সে হুট করে একদিন প্রজাপতি হয়ে যাবে তুমি এলে। সব্বাই হাঁ হয়ে যাবে কিন্তু!

তুমি এলে গানটা নিয়ে বসব, বুঝলে? বাড়ির লোকের আর আফসোস থাকবে না ভাল গলাটা নষ্ট করছি বলে। গীতবিতান তো কাছেই থাকে, শুধু গান দেবার মত মানুষ থাকে না। যদি আসো, তখন তুমিই আমার ঘুম ভাঙানিয়া, তুমিই দুঃখজাগানিয়া। আর এইবার গোটা বাড়িতে সুর ঘুরে বেড়াবে পায়ে পায়ে। তবু আমার হিয়া বিরাম পায় না যে!

যা যা কিছু পারি অথচ অভিমানে করিনি এতদিন, সেসব করব এইবার। ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরব। এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ানোর প্রয়োজনই হবে না। আর আমার কোলকাতা অবসেশন? সেও নাহয় তোমার সঙ্গেই হবে। ছুটি হলে ঘাট... নৌকো... হাওয়াই মিঠাই... হলুদ ট্যাক্সি... শীতে বইমেলা... মৌড়ি লজেন্স...মিউজিয়াম... ফাঁকা রাস্তা... আইসক্রিম... বাংলা সিনেমা... কফিশপ... তুমি এলে, এ শহরের যা যা কিছু আমার একার, সব আধাআধি হবে কেমন? আচ্ছা... আধাআধি না, তোমায় একটু বেশিই দেব। ভালবাসলে ভাগ করতে নেই। যা তোমার তাই আমার।

তুমি এলে এবার একটা গান আর একটা গল্প লিখব। প্রেমের। পাঠক চায় খুব, আমিই এতকাল পারিনি প্রেমের অভাবে। এবার সত্যি লিখব। লিখেই তোমায় পড়াবো, তারপর ছড়িয়ে দেব। কপিরাইট রাখবনা। আমি চাই এ শহরে প্রেমের গান আর প্রেমের মানুষ বারবার চুরি যাক

এই যাহ! কাজের কথাই বলা হল না যে! বসন্ত নিয়ে একটা ফিরিস্তি আছে কিন্তু। শুনে নাও- তুঁতে, হলুদ, গোলাপী আর সিঁদুরে লাল এই চার রঙের আবীর। মনে থাকবে? তুঁতে, হলুদ, গোলাপি আর লাল। ফাল্গুন মাস পড়লেই চাই। না,  মোটেই ছেলেমানুষি না। আমার কি দোষ? বসন্তে জন্মানো মেয়ে যে... রাধিকার হোরি নইলে চলে কখনো? অতএব, ফুল ফুটুক না ফুটুক, সেদিন বসন্ত হবে।

তুমি এলে বারোমাস প্রতিবাদ... বারোমাস প্রেম...বারোমাস অঞ্জন সুমন রূপম... একসাথে মিছিলে যাব। দেশ শহর গ্রাম সব তো এক। কোথাও অন্যায় দেখলেই, ধরে থাকা হাতদুটো নিমেষে ব্যারিকেড। প্রতিরোধ সেরে শেষ বাসে বাড়ি ফিরব কাঁধে মাথা রেখে। বাবা বলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানুষ ভাল হয়। তুমিও বাবার মত ভাল হবে। হবে তো?

তুমি এলে ইচ্ছের ছুটিতে তোমার পাহাড়। আর দুঃখে, আমার সমুদ্র। রাগ করলে কপালে সেই বিশেষ স্নেহ আর ভাত খাইয়ে দিলেই চলে কিন্তু তাতেও যদি কাজ না হয়, কোনো কারণে যদি কথা বন্ধ, যদি অভিমান, যদি অসুখ, যদি বিরহ... তবে কিন্তু ছুটি নিয়ে সোজা জঙ্গল- কথা হয়েই রইল। ওখানে রাত নামবে আর দেখবে আমাদের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে আবার সব।

ব্যাস। এটুকুই। একে সুখ বলে সুখ, ঝক্কি বললে ঝক্কি। তুমি এলে এসব সুখ হবে, এসব ঝক্কি হবে। তুমি না এলে এসবের কিচ্ছু হবে না। সহজ হিসেব। তখন আর কি? এই জীবন এই জীবনই রইল। আমি তোমায় পেলাম না আর তুমি পেলেনা এমন একজনকে, যে ছুঁয়ে দিলে সবকিছু ভালবাসা হয়ে যেতে পারত রাতারাতি। তুমি এলে সেসব প্রিয় হবে, না এলে নয়। তখন তোমার না আসা কবিতায় সবাই পড়বে, তোমার না আসার গল্প আমার লেখা হয়ে বিক্রি হবে কলেজস্ট্রিটে। মেটাফর বুঝলে, হুঁ হুঁ, সব কেমন মেটাফর হয়ে যায়...

আমার দোতলার ঘরটা একরকমই থাকবে। ভারি পর্দাটা সরাবে না কোনো হাওয়া। আমার নীল আলো কখনো হলুদ হবেনা আর। আমার ডায়েরি নিয়ে প্রকাশক আর দু একটা বন্ধু ছাড়া কারো কোনও কৌতুহল থাকবেনা। সবাই মিলে আমার সব ডায়েরিকে একদিন বই বলে ছাপিয়ে বার করে দেবে। বইমেলায় বিক্রি হবে সেইসব তোমার অজান্তেই। কোনোদিন কোনো ম্যাগাজিনে এক ছদ্মনামীর লেখা পড়ে হয়ত চমকে উঠবে তুমি! তোমার চেনা চেনা লাগবে সব। হয়ত তোমার আফসোস হবে কিম্বা কিচ্ছু হবেনা। তবে আমার কিন্তু নাম হবে আরও... লোকে সমীহ করবে। শুধু মায়ের কাছে খাওয়ায় ঘুমোনোয় নিজের খেয়াল রাখায় আমার আর এজম্মে লক্ষ্মী মেয়ে হওয়া হবে না।

বয়স বাড়বে। কাজ বাড়বে। একটা বয়সের পর হয় নিয়মিত ঘুমের ওষুধ লাগবে নয়ত দুঃস্বপ্ন সওয়ার জোর। কাজল ছাড়া আর কিচ্ছু থাকবেনা আমার সাজবাক্সে। প্রতিবাদে আর ব্যারিকেড নয় থাকবে ভেতরে ক্লান্ত আর বাইরে শক্ত একটা মুঠো। তোমার ওপর নাকি নিজের ওপর রাগ করে একটা গানও গোটা গাওয়া হবে না আর কোনোদিন। স্নানের ঘর জানবে শুধু প্রেমের গানে, প্রেমের লেখায় আসলে আমি একটা ভাসা ভাসা মুখ খুঁজি। তুমি না এলে আমার কোলকাতা গোটাটা আমারই থাকবে। আমার ছোট ছোট চোখে, মুঠোয় একটা গোটা শহর উপচে পড়বে অথচ তাকে ভাগ করে নেবার মত কেউ থাকবেনা।

তুমি, প্রেম, তুমি না এলে আমার সমস্ত ফাল্গুন শুধু রঙ জমিয়েই কাটবে, সে রঙ ছোঁয়ানো হবে না আর কাউকে। আমি পাহাড় থেকে ছুটি শেষ হবার আগেই ফিরে পড়ব, সমুদ্রে ডুবব তবু দুঃখ ধুয়ে যাবে না কিছুতেই। অভিমান করে লাভ হবে না জেনেও সেদিন যদি কিছু ছেলেমানুষী অভিমান করে ফেলি একাই জঙ্গলে যাব। ওখানে রাত বাড়বে আর আমার গায়ে জ্বর... এই যেমন এখন। লোকে বলবে অসুখ। আমি জানব- অপ্রেম। লোকে বলবে- পাগলামি। আমি জানব- অপেক্ষা।

আসলে- তুমি না এলে অনেক কিছু হবে, তুমি না এলে বহু কিছু হবেনা। তবে যাই হোক। আমি কিন্তু বাঁচতে চাই। এই শহরটার মত... পাওয়া, না পাওয়ার সব ক্যাকাফনি গায়ে জড়িয়ে বাঁচতে চাই। মরতে তো আমাদের সবাইকেই হবে একদিন! ওতে আর নতুন কি বাহাদুরি ? শুধু  তুমি এলে আনন্দের বিষে মরব আর না এলে- বিষাদের অমৃতে। তফাত বলতে তো এটুকুই...

ইতি,
আর কে? একটা হতচ্ছাড়া, একটা আধপাগল কিন্তু কোত্থেকে যেন এই বয়সেই ভালবাসার আসল মানেটা ধরে ফেলা এক আস্ত পাকাবুড়ি 😊

সৃজা ৪

এখান থেকে আমায় নিয়ে চলো
চারপাশ খুব অন্যরকম লাগে
কেমন যেন পাথর হয়ে গেছি
যন্ত্রণা আর বিফল অনুরাগে।

যেসব মানুষ হাসতে পারে বেশি,
তাদের থেকেই সব অভিনয় শেখো।
আমায় তুমি সঙ্গে নিয়ে চলো
আমায় তুমি নিজের কাছে রেখো

আমরা যারা এক্কেবারে ঠকে
প্রমাণ হলাম যাবজ্জীবন হেরো
রক্তপাতে হার মানি রোজ রাতে,
তাদের দিকেও একটুখানি ফেরো?

জানি অনেক পিছিয়ে পড়ে আছি
ভালবাসা বলতে বুঝি - 'থাকা'
জীবন মানেই ভাবি লাটাই ঘুড়ি
ভয় জাগে তো মুখোশ এবং টাকায়।

বন্ধু ছিল। হয়ত আছেও কিছু
তবুও কি এক মুখ খুঁজেছি... জানো?
যে একটা ঘর খুঁজে দেবেই শেষে
যে জানবে এই অবুঝকে সামলানো

মরতে হলে মরব না হয় পথেই
এর চেয়ে খারাপ কি হবে আর বেশি?
সঙ্গে নিলে পাশের মানুষ হবো
নইলে তো সেই... স্নিগ্ধ পরদেশী...

রূপকথা সব মাটিই হবে জানি
বসন্তদিন বর্ষা দেবে ঢেকে
তবুও তুমি আমায় নিয়ে চলো
আমায় নিয়ে চলো এখান থেকে।

সৃজা ৩

এভাবে বলে নি কেউ, কেউ তো বলেনি এইভাবে-
ঝড় টড় পার করে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে!
রাগ হবে তবু চোখে বাঁচবে নিখাদ আশ্রয়
আমাকে না চেনো যদি, জানোই নি- প্রেম কিসে হয়...

এভাবে বাঁধেনি কেউ যত্নের স্বরলিপিটিতে
এভাবে নেয় নি কেউ নির্জনে, গাঢ় সন্ধিতে
এভাবে হয়নি কথা চোখেদের আলো দিয়ে ঘিরে
এভাবে যাবার কালে কেউ তো দেখেনি ফিরে ফিরে!

এভাবে বলেনি কেউ ভালবাসি, খুব ভালবাসি
এভাবে বোঝেনি ব্যথা- কেন চিৎকারে থেমে আসি!
এভাবে রাখে না কেউ সব খাতে, সব অভ্যেসে
এভাবে চায় নি কেউ প্রতি কটা রাত্তির শেষে

এভাবে টানেনি কেউ যাতে মুশকিলই হয় ছাড়া
এভাবে জড়িয়ে কেউ দেয় নি যত্ন বা পাহারা
এভাবে কাঁদে নি কেউ আমাকেও হারাবার ভয়ে
এভাবে আদর করে রাখেনি সাহসে... প্রত্যয়ে...

এভাবে দেখে নি কেউ- অভিমানে আভরণহীনা
কেন চুপ করে থাকি, একটাও প্রশ্ন করি না!
এভাবে খোঁজে নি কেউ ঘুম ভাঙা ওলটে পালটে
তীব্র স্লোগানে আর একাকিত্বের নীল জোটে

এভাবে মারেনি কেউ, কেউ তো মারে নি এইভাবে-
যেভাবে হত্যা হলে আজীবন বেঁচে যাওয়া যাবে।
বিষে তো অর্ধমৃত অথচ রাখি না প্রাণে ফাঁকি
আমাকে না নাও যদি, শিখবে না- ভালবাসাটা কি?

-©সৃজা

গানের ওপারে- সৃজা ঘোষ

গানের যা কথা, সব চুরি হয়ে গেছে
মাঝরাতে পড়ে আছে সুর অভিমানী
কেন চোখে জল এল এতকাল পরে?
সেসবও কি আমি ছাই ঠিক করে জানি!

শুধু মনে আছে চোখে আলো পড়ছিল
চার দিক ভেসে যাচ্ছিল চেনা ভিড়ে
আমার আর ঠিক কি কি হারানোর ছিল-
চোখ বুজে আসা এই গানটিকে ঘিরে?

যেন কেউ কাছে তবু খুব কাছে নয়...
মায়া বেড়ে গেলে সব ভুলত্রুটি ক্ষমা
যতবার চোখ ফেটে জল এসেছিল
ততবার গানে ব্যথা করে গেছি জমা

গলা ধরে আসছিল, বাড়ছিল হাওয়া
পায়ের যেটুকু মাটি যাচ্ছিল সরে...
যে মানুষ কাছে তবু ঠিক কাছে নয়,
তাকে আমি বেঁধে রেখে দিই অক্ষরে।

সেও বুঝি সুর হবে অচেনা দুপুরে!?
আলোর দিব্যি দিয়ে সামলাবে ক্ষত
কান্নার পরে চোখ খুলে দেখবই-
গানের ওপারে তুমি, দাঁড়ানোর মত...

আত্মসমর্পণ- সৃজা ঘোষ

ছেড়ে যাব বলে একে একে মায়া কাটিয়ে উঠছি আমি
প্রিয় করিডোর ছলকে উঠছে না পাওয়া দিনের আলোয়
সময় এবং সহমর্মিতা চাইতে গেলেই বুঝি-
কিছু মোমবাতি নেভানোর চেয়ে পুড়িয়ে দেওয়াই ভালো

দেখা হবে বলে ছুটে যাওয়া আর ফেরার শূণ্য হাতে
দূর থেকে যদি ভালবাসা যায়, কার কি বা তাতে ক্ষতি?
বৃষ্টিকে আমি আসতে বলেছি কান্না লুকোবো বলে
মরতে মরতে হেঁটে যাওয়াটাই জীবনের পরিণতি।

ইচ্ছের ঠিক ঠিকানা থাকে না, এমনিই চায় লোকে
ঘুমোতে না পেরে সারারাত ধরে জেগে বসে থাকে ক্ষত
ফেরবার আগে শেষ ইচ্ছেটা? বনেদী বসন্ততে
তার হাত ধরে সমস্ত দিন বেড়াবো ঝড়ের মত...

অধিকারবোধ বাড়িয়ে ফেলেই সরে আসি ভীতু পায়ে
যদি ভালবাসা প্রকাশিত হয়ে কান্নাটি যায় শোনা!
আমার যা হয় হোক তবু এই ভীষণ গুমোট দিনে
তোমাকে আমার বায়নার ঘরে আর টানবো না

চাইলে সবই তো কেড়ে নেওয়া যায় তীরন্দাজের মত
লক্ষ্যভেদে যে বিশ্বাসী নয় আসল জ্বালা তো তারই
নিজেকে এতটা কঠিন করেই কষ্ট দেবার পরেও
দূর থেকে কোনো দাবি না জানিয়ে ভালবেসে যেতে পারি

পাতা টাতা সব ঝরে গিয়ে শেষে পড়ে আছে শুধু কাঁটা
কেউ তাতে হাত ছুঁয়েও দেখে না রক্ত পড়ায় ভয়ে
একা গাছটিই এফোঁড় ওফোঁড়, বলতে পারেনি তবু-
কয়েকটা ফুল ফুটতে পারত আদরের বিনিময়ে...

মায়া বাড়ে বলে একা একা তাকে ছেড়ে যেতে হবে জানি
না পাওয়া দিনের আলো পড়ে চেনা করিডোর চমকায়
আমার জন্যে কারোরই কখনো সময় ছিল না বলে
কিছু মোমবাতি নেভানোর আগে পুড়িয়ে ফেলাই যায়।

সৃজা ২

চাঁদের আলোয় আকাশ ধুয়ে গেছে
বিচ্ছেদে আজ চোখ পড়েনি তাই
কোথাও জানি আমার ঘরও আছে
আজ সেখানে পৌঁছে যেতে চাই।

মুঠোয় আবির ভরেই রাখা থাকে
রঙ খেলাতে বিপক্ষ হয় নাকি?
কে আমাকে ছাড়ল ভুলে গিয়ে
কে আমাকে চাইল মনে রাখি...

ঘুমের ভেতর স্বপ্ন জড়ো করি
আদর চাদর মন শরীরের পাশে
এমন দিনে শান্ত মেয়ের কোলে
ছাদের মায়ায় জ্যোৎস্না নেমে আসে

কোন তারাটা আমার কাছাকাছি
না ডাক পেয়েও পড়তে পারে খসে!
ডাকলে সাড়া দেবার তো কেউ নেই
তাই সারারাত চাঁদের কাছে বসে

পায়ের কাছে অল্প ধূলোর রেশ
ঠান্ডা হাওয়ায় শিরশিরে গান চালু
যাওয়ার কথা কোথায়?- জানি না তো!
অসার হয়ে আসছে হাতের তালু

এখন এ চাঁদ ধরব কেমন করে?
তার চেয়ে বরং এ বিষ গায়ে মাখি
যে আমাকে সামলাতে আসবেই-
আমিই তো তার বসন্ত হই, নাকি?

তোমার সাথে কোথায় প্রথম দেখা?
তোমায় আমি কেমন করে চিনি!
অভিমানের চরকা কাটে সুতো
বাসলে ভাল, সবাই কলঙ্কিনী

ফেরার হবার রাস্তা কোথায় বলো? 
সারাটা রাত জেগেই আছি তবে...
চাঁদের আলোয় আকাশ ধুয়ে গেছে
তোমার কাছেও আমায় যেতে হবে

(সৃজা ঘোষ)

পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে ফুটে উঠছে আলো
ঘুম ভাঙছে মফঃস্বলের, ঘুম ভাঙছে পাড়ার
আয়না জুড়ে অন্যরকম প্রতিবিম্ব, ঢালও
অসম্ভবের দরজা খুলে ঢুকে পড়ল কারা!

বসন্তের কারুকার্য রক্তে ফুটে ওঠে
চতুর্দিকে অসুখ বিসুখ, দীর্ঘ মহামারি
ভোরের আগেই ঠান্ডা চোখে কৃষ্ণচূড়া ফোটে
বিপদ এখন আরামপ্রদই, হাওয়ায় নেশা ভারি

অনন্ত এই ভুবনডাঙা শান্ত হলে গানে
মৃত গাছের কোটর থেকেই কোকিল যাবে চুরি
অন্ধ হয়েও যেকটা লোক রঙের হদিশ জানে
তাদের কাছে সব আগুনই - ব্যার্থ বাহাদুরি...

কয়েক জন্ম পেছন দিকে ছুটতে হবে বুঝি
অনুসঙ্গ ভাল জিনিস, চিনতে শেখায় জল।
আয়না ভেঙে বসন্তদিন দাঁড়ায় সোজাসুজি
ঘুমিয়ে পড়ে দূরের পাড়া, কাছের মফঃস্বল

আলবিদা- সৃজা ঘোষ

এবার দেখো সত্যি সত্যি সেরে উঠব আমি
ছুঁড়ে ফেলব কাঁচের শিশি, সব নিয়মের ঘটা
অসুখ বুকে নিয়েও যারা স্বপ্ন দেখতে পারে
তাদের কাছে দুঃখ থিতু, বসন্ত রগচটা।

শরীর পরীক্ষা করে হাতিঘোড়াই হবে
অনেক কাল ভোগা হল, এবার ছাড়ান দাও
মুঠো ভেঙে সময় কেমন বেড়িয়ে যাচ্ছে, দ্যাখো
এর মধ্যেই মরব নাকি!? যাব না এক পা-ও?

ক্ষত সারতে অনেক বাকি, তবুও য'দিন আছি
চতুর্দিকে ছড়িয়ে যাবো হাসির মহামারি...
আমরা যারা অবহেলাও হজম করে নিলাম,
বিদায় নেবার আগে তারাই বাঁচিয়ে যেতে পারি।

কিন্তু এসব বোঝার মত ধৈর্য নেই কারোর
হয়ত প্রিয় সমুদ্রতেই মিথ্যে জাহাজ ভাসে
কাছের লোকের সঙ্গে এসব যুদ্ধ করতে গেলে
অস্ত্র ছোঁড়ার আগেই দু চোখ ঝাপসা হয়ে আসে

ভালবাসতে সাহস লাগে, আমি দুঃসাহসী
আরোগ্য আশাতীত, অভিজ্ঞতাও যম।
মরতে মরতে তবুও যা যা স্বপ্ন রেখে যাবো,
তাতেই জেনো সফল হবে প্রেম আর পরিশ্রম।

ভয় পেও না বন্ধুমহল, ভয় পেও না পাড়া
চোখের জল বহুমূল্য, খরচ করতে নেই
আমরা যারা কাঁদতে কাঁদতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম
এখন তারা হাসতে হাসতে যাচ্ছি এভাবেই..

চাইছি কৃষ্ণচূড়া হতে- সৃজা ঘোষ

দুর্বল নই তাও প্রবল ক্লান্ত হয়ে আছি
আক্রমণের চোটে বিশ্বাস ভাসিয়েছি স্রোতে
ক্রমাগত সব হারাবে এ নিয়তি মানবার পরও
তোমাকে দেখেছি যত, চেয়েছি কৃষ্ণচূড়া হতে।

আঘাতে সবটা গেছে। প্রিয় আলো, মায়া, ঘুম, হাসি
অন্ধকারের পরে আলো দেখে ভয় পায় চোখ।
যে মানুষ প্রতিবার ভালবেসে হেরে যাচ্ছিল
মনে মনে সেই চায়- সকলের ঘর সুখী হোক...

বাইরে অনেক খ্যাতি। ভেতরে তো তোলপাড় ক্ষত
কাছে আসবার দাবি বহু জন বহু ভাবে করে
ভালমানুষির দায়- ফেরাতে পারিনি কোনোদিনই
অতএব ব্যবহার, ছুঁড়ে ফেলা ঠিক তারপরে৷

এসবের মাঝখানে হুট করে কেউ কেউ আসে
ভীতু মনটিকে কাছে নিয়ে বসে নিভৃতের জনই...
যাদের বসন্তদিন বহু আগে চুরি হয়েছিল
তাদের ব্যথাকে নিয়ে কোনোদিন কেউই ভাবো নি।

তুমি ভাবো, এটুকুই আজকের আঁধারে জরুরি
নির্বাসনের পরে কোনও দিন যদি ফেরা হয়,
আমার যেটুকু আলো, যতটুকু খ্যাতি তা তোমারই।
কেননা তুমিই বলো- দুঃখটা বড় কথা নয়

অতএব অভিমান ভেঙে গেল হাওয়াতে হাওয়াতে
হয়ত ক্লান্ত তবে এবার শক্ত হবো, দেখো...
যারা চলে যেতে চায়, তাদের যাবারই কথা ছিল
তোমাকে ভরসা করি। তুমি শুধু পাশটাতে থেকো।

আর যদি না চাও তো- বলে যেও, ব্যাস এতটুকু।
আটকানো যায় না যে শেখা হয়ে গেছে এ কথাটি...
একাই পারতে হয় তবু কেউ সাথে রয়ে গেলে
আমরা বাকিটা পথ তাকেই সঙ্গে নিয়ে হাঁটি।

ততটা শক্ত নই যতটা বাইরে থেকে লাগে...
আক্রমণের দিনে বিশ্বাস বয়ে যায় স্রোতে
ক্রমাগত সব হারাবে এ নিয়তি মানবার পরও
তোমাকে দেখছি যত, চাইছি কৃষ্ণচূড়া হতে

তবুও আশা থাকে- সৃজা ঘোষ

কবিতার পায়ে ছায়া রাখে রূপকথা
আদরের ফুল কাঁটায় পা ফেলে বাড়ে
ভালবাসবার মানুষ এখন বিরল
চারিদিকে শুধু দানব নজর কাড়ে...

মিথ্যের কাছে আদরের পোয়াবারো
শেকড়েও বিষ চোখের আড়ালে ঢালি
এখন রাত্রি বলতে- না আসা ঘুম
কোনো কোনোদিন জোটে চাঁদ, একফালি।

ঘরের পর্দা ব্যথা লেগে বেশ ওড়ে
ছায়াঘেরা বাড়ি- শীতল, যেমন হয়
আমরা তো সেই ছোটো থেকে শুনে গেছি
যন্ত্রণা হলে, সহ্য করতে হয়।

তাই হাসিমুখ পরিজন দিয়ে ঘেরা
সংসার আর হিসেবের খড়কুটো
মাঝরাত্তিরে পাশ ফিরে কেউ নেই
প্রেমের অভাবে ভরে যায় সারা উঠোন!

সে উঠোনে হাঁটি পায়ে পায়ে স্বপ্নতে
নুন আনতে গেলে পান্তা ফুরিয়ে যায়
ভাল থাকবার চেষ্টা করতে গেলে
যতটা শক্তি, সবটা ফুরিয়ে যায়

তবু আশা থাকে একদিন পাশ ফিরে
অভাব না আর, মানুষ দেখব পাশে
চেনা ভিড় থেকে সে আসবে হুট করে
অনটনে ভরা এ মরা ফাগুন মাসে!

সুন্দর- বদরে মুনীর

শত শত সুন্দর মুখ দেখে আমাদের দিন চলে গেছে
শত শত সুন্দর মানুষ দেখে জীবনের বারোটা বেজেছে

বেলুনের বাতাস ফুরালে তবু থেকে যায় ছেঁড়া ছেঁড়া দাগ
যে-রকম জননী জঠরে থাকে ধারণের স্মৃতিরা সজাগ

আর কোন পাওনা নাই কারও কাছে, মগজে কোথাও নাই ঘোর
যে-যার বেতনে চলি, পাল-পাল, একা একা জঘন্য সুন্দর

Wednesday 1 April 2020

Saturday 28 March 2020

বিরহ- শঙ্খ ঘোষ

গভীর ঘুমের মধ্যে
হাসিমুখে সর্বনাশ এসে দাঁড়ায়
তার আদরে আদরে ভরে যেতে থাকে আমার অপাবৃত শরীর

ক্ষতগুলি চেনা যায় জেগে উঠবার বহু পরে
ততক্ষণে, সেও কাছে নেই