জ্বরকে চিরকালই আমার কেমন যেন এক মায়াবী অসুখ মনে হয়। পারদে পারদে জানান দিয়ে সে আসে অনতিবিলম্বে। আতিশয্যে নয়, গোপনে যেভাবে আসে প্রেম, যেভাবে আসে মরণ, যেভাবে আসে অভিমান... কাঁচের মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট ফুটে ওঠে আগমনী৷ জ্বরের খবরে প্রিয়জনের মুখ ভার হয়, ফুরফুরে মেয়ে জ্বরে পটে থম মেরে যায়, এতকালের লুকিয়ে রাখা ব্যথা যা করতে পারেনি, জ্বর তা অনায়াসে পারে। আমি কাঁদিনা অথচ চোখ ছলছল করে! চোখ বন্ধ করতে পারি সহজে অথচ ঘুমোতে ইচ্ছে করে না! খেতে ইচ্ছে করে না! শুধু রাগ করতে ইচ্ছে হয়। তখন ভেতরে শীত, বাইরে আগুন গা। তখন বলে দিলেই ভাল, কিন্তু বলতে পারছি না। জ্বর আসে। যাদের ছোঁয়ার অধিকার নেই, তারা কতকিছু ভাবে আর যারা অনায়াস জোর খাটানোর মত আপন, তারা খালি কাজের ফাঁকে গাল কপাল ঘাড় ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে। গম্ভীর মুখে বলে ওঠে- ' মনে হচ্ছে ভোগাবে'। জ্বর এলে কেউ ছেড়ে যায় না, থার্মোমিটার নিয়ে আসে, গায়ে চাদর টেনে দেয়, সব আব্দার তখন আপনিই মঞ্জুর হয়ে যায়। প্রিয় বন্ধু বান্ধব ফোনে লেগে থাকতে চায়, আর যাদের জীবনে বিশেষ সংজ্ঞাহীন কেউ থাকে তারা নাকি বকে, অন্যদিনের চেয়ে কিছু বেশি ক্ষণ থাকে! তারা নাকি গান শোনায়! আগুন গা জড়িয়ে ধরে রূপকথার গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ায়- জ্বরের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে রাজপুত্তুর তুলে আনে এ পৃথিবীর সবচাইতে শীতল মাটি। সে মাটি রাজকন্যার জ্বোরো গায়ে লেপে দিলে তবে জ্বর সারে। পোড়া গা মন ঠান্ডা হয়। পায়ের পাতায় সাড় আসে।
জ্বরকে চিরকালই আমার খুব নরম বিষাদ মনে হয়। তার রঙে নীল, তার ঢঙে ছেলেমানুষী, পরণে অহংকার। তার আসায় যাওয়ায় কমায় বাড়ায় কারোর জেহাদ খাটে না, কেবল আদর খাটে। তাই জ্বর এলে মাথা ধুইয়ে দিতে হয়, ভাত খাইয়ে দিতে হয়, মাঝে মাঝেই কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে যতটা সম্ভব নরম করে বলতে হয়- 'এই তো আছি', হাতের পাতায় পায়ের পাতায় ওম দিতে হয়, আড়ালে খোঁজ নিয়ে যেতে হয়, সে ঘুমিয়ে পড়লে সারারাত জেগে জেগে উঠে দেখতে হয়- জ্বর বাড়ল কিনা। জ্বর আসলে একরকম মদ। নেশা ধরায়৷ এ সময় বেশি বলতে ইচ্ছে করে না, কেউ গল্প শোনালে বেশ ভাললাগে। মেরে দিতে নয়, মরে যেতে ইচ্ছে করে। ঘ্যানঘ্যান গুলোকে প্রশ্রয় দেবার কেউ থাকলে সেরে উঠতে ইচ্ছে করে। কষ্ট হলে চুপ করে থাকতে ইচ্ছে করে। গল্প থামলে রাগ হয়, গান থামলে আরও। কেউ চলে যেতে চাইলেই চাদর সরিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। কেউ কাছে না থাকলেই ঠান্ডা জলে স্নান করে একটা বিপর্যয় ঘটাতে ইচ্ছে করে। তারপর জ্বর বাড়লে কিছু মনে থাকেনা। জ্বর সারলে তাকিয়ে দেখি মশারির মধ্যে রোদ ঢুকেছে। কেউ যেন হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাথায়, কেউ যেন বলছে- 'যাক বাবা, এবারের মত রক্ষে! '
জ্বর রক্ষে পায় না। সে হাওয়ায় হাওয়ায় থাকে। মাঝে মাঝে ফুরফুরে মেয়েদের গায়ে এসে বসে প্রজাপতির মত। প্রথমে গা ছ্যাক ছ্যাক করে, তারপর সে আসে সমারোহে। জ্বর এলে ক্লান্তিতে, ছেলেমানুষীতে মানুষকে আরও হাজারগুণ সুন্দর দেখায়। কি এক আলো নরম করে দেয় তার সমস্ত সামলে চলা। উষ্ণ চোখে ফুটে ওঠে অসুখে মোহময়ী এক ঐতিহ্যবাহী ব্রহ্মকমল৷
তার অমন পাগল করা রূপ ভোলা যায় না। জ্বর হলে সরে যাওয়া নিয়ম। সবাই হাত রাখেনা কপালে। আর যারা ছোঁয়, যারা হাত রাখে, সাথে নিয়ে বাড়ি ফেরায়, ঘন্টায় ঘন্টায় খোঁজ নেয় থার্মোমিটার কি রিড দিচ্ছে, তারা পরবর্তী সবকটা জ্বরের অধ্যায়ে অসুখ সামলাতে আজীবনের মত থেকে যায়...
সবার সাথে জ্বর ভাগ করা যায় না। কারোর কারোর সাথে যায়। মা বাবার পর আমরা মেয়েরা সারাজীবন ধরে বোধহয় এই জ্বর ভাগ করার মানুষই খুজি। 🙂