Saturday 4 April 2020

মনে মনে বহুদূর চলে গেছি- শক্তি চট্টোপাধ্যায়

মনে মনে বহুদূর চলে গেছি
যেখান থেকে ফিরতে হলে আরো একবার জন্মাতে হয়
জন্মেই হাঁটতে হয়
হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে
একসময় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে পৌঁছুতে পারি
পথ তো একটা নয় –
তবু, সবগুলোই ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে শুরু আর শেষের কাছে বাঁধা
নদীর দু – প্রান্তের মূল
একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূণ্য
দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোরেন –
দুটো জন্মই লাগে
মনে মনে দুটো জন্মই লাগে।

তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরো বেশি ভালোবেসে ফেলি- মহাদেব সাহা

তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরো বেশি
ভালোবেসে ফেলি
তোমাকে ছাড়াতে গিয়ে আরো
বেশি গভীরে জড়াই,
যতোই তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই
দূরে
ততোই তোমার হাতে বন্দি হয়ে পড়ি,
তোমাকে এড়াতে গেলে এভাবেই
আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যাই

এভাবেই সম্পূর্ণ আড়ষ্ট হয়ে পড়ি;
তোমাকে ছাড়াতে গেলে আরো ক্রমশ
জড়িয়ে যাই আমি
আমার কিছুই আর করার থাকে না।
তুমি এভাবেই বেঁধে ফেলো যদি দূরে
যেতে চাই
যদি ডুবে যেতে চাই
তুমি দুহাতে জাগাও।
এমন সাধ্য কী আছে তোমার চোখের
সামান্য আড়াল হই,
দুই হাত দূরে যাই
যেখানেই যেতে চাই সেখানেই
বিছিয়ে রেখেছো ডালপালা,
তোমাকে কি অতিক্রম করা কখনও সম্ভব
তুমি সমুদ্রের চেয়েও সমুদ্র
আকাশের চেয়েও আকাশ তুমি আমার
ভেতরে জেগে আছো।
তোমাকে ভুলতে চেয়ে তাই আরো
বেশি ভালোবেসে ফেলি,
তোমাকে ঠেলতে গিয়ে দূরে
আরো কাছে টেনে নেই
যতোই তোমার কাছ
থেকে আমি দূরে যেতে চাই
ততো মিশে যাই নিঃশ্বাসে
প্রশ্বাসে,
ততোই তোমার আমি হয়ে পড়ি ছায়ার
মতন;
কোনোদিকে যাওয়ার আর একটুও
জায়গা থাকে না
তুমিই জড়িয়ে রাখো তোমার কাঁটায়।
তোমাকে ছাড়তে গিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে
আরো জড়িয়েছি
তোমাকে ভুলতে গিয়ে আরো
ভালোবেসেছি তোমাকে।

কে চায় তোমাকে পেলে- মহাদেব সাহা

বলো না তোমাকে পেলে কোন মূর্খ অর্থ-পদ চায়
বলো কে চায় তোমাকে ফেলে স্বর্ণসিংহাসন
জয়ের শিরোপা আর খ্যাতির সম্মান,
কে চায় সোনার খনি তোমার বুকের এই স্বর্ণচাঁপা পেলে?
তোমার স্বীকৃতি পেলে কে চায় মঞ্চের মালা
কে চায় তাহলে আর মানপত্র তোমার হাতের চিঠি পেলে,
তোমার স্নেহের ছায়া পেলে বলো কে চায় বৃক্ষের ছায়া
তোমার শুশ্রূষা পেলে কে চায় সুস্থতার ছাড়পত্র বলো,
বলো না তোমাকে পেলে কোন মূর্খ চায় শ্রেষ্ঠ পদ
কে চায় তাহলে বলো স্বীকৃতি বা মিথ্যা সমর্থন,
তোমার প্রশ্রয় পেলে কে চায় লোকের করুণা
বলো কে চায় তোমাকে ফেলে স্বর্ণমুদ্রা কিংবা রাজ্যপাট?
বলো না তোমাকে পেলে কোন মূর্খ অন্য কিছু চায়,
কে আর তোমার বুকে স্থান পেলে অন্যখানে যায়!

রঙবুদ্বুদ- রণজিৎ দাশ

ঝাঁকে ঝাঁকে চিঠি উড়িয়ে দিয়েছি তোমার চতুর্দিকে
ফু দিয়ে যেভাবে বালক ওড়ায় রঙবুদ্বুদ, এবং
নিজেই খুশিতে হাততালি দেয়, মশগুল চোখে হাসে।
পৃথিবীতে শুধু বুদ্বুদ-ই জানে বিচ্ছুরণের জাদু-
আপাতত তাই বালক বুঝেছে, সাবানফেনার পিছল
তাকে চিনিয়েছে স্কুল পালানোর অন্ধনতুন গলি
আমি তো চিনেছি তারও থেকে বেশি, জেনেছি কঠিন প্রিজম
শাদা আলোরেখা চুর চুর করে, নিহিত বর্ণমালা
তোমার শরীরে কেন ফুটে ওঠে আলিঙ্গনের আগে;
জেনেছি শরীরে কেন ফুটে ওঠে আলিঙ্গনের আগে;
জেনেছি তোমাকে - শাদা আলোরেখা, তুমিই ভ্রান্তি,
                                                     তোমারই বর্ণমালা
দেখেছি তোমার চুম্বনছবি শস্যে ও গানে, দেশি থিয়েটারে,
                                         মানুষের বোকা ঠোঁটে
আমি-ও সকল চিঠিতে লিখেছি 'চুম্বন দাও, আলজিভ', তুমি
এত আর্তিকে অবহেলা করে গোপনে কেবল পালিয়ে গিয়েছো দূরে
যেখানে অজ্ঞ বালক ওড়ায় রঙবুদ্বুদ, ভাবে-
               পৃথিবীতে শুধু বুদ্বুদ-ই জানে বিচ্ছুরণের মায়া

সামান্য কবিতা- ভাস্কর চক্রবর্তী ।

ঝড়-বাতাসের দিনে আবার তোমার সঙ্গে দেখা!
আবার তোমার সঙ্গে কথা!
আবার তোমার সঙ্গে গান ।

এরকম মনে হয় কোনোদিন যখন জীবন খানখান ।

       (কৃত্তিবাস ১৪-০১-১৯৮২)

সৃজা ৮

রোদ পড়েছে মন খারাপের আস্তিনে
কান্না চিবুক ছোঁয়ার আগেই শুকিয়ে যায়
আজও হৃদয় ভাঙার কোনো বিধান নেই
আমার ঘরে কিম্বা ওদের পঞ্জিকায়।

অনেকগুলো দিন কেটেছে এই করে
বেডরুমে তাই ধূসরতার পাশ বালিশ
নিয়মমাফিক জ্বর আসেনি আজ ভোরে
বুকের ভেতর আর লাগেনি সব খালি।

সব অভ্যেসই সময়মতো ফুরোয় ঠিক
এই জীবনে কোনো আদর স্থবির নয়
যার যতটা সুযোগ নেবার, সে তাই নিক।
থাকার মানুষ সারিয়ে দেবে এসব ক্ষয়

লক্ষ্য যদি স্থির রেখে দেয় মাছের চোখ,
দুঃখ চুলের ক্লিপের মত - আনমনা;
মায়ার শরীর এবার যতই মেঘলা হোক
যত্ন করে সেসব তুলে রাখব না।

বরং তাকে ছড়িয়ে দেবো জীবনভোর
লাল মিছিলে, দূরের কোনো নীল গ্রহে
অপেক্ষাতে যে বোঝাবে আসল জোর,
তাকেই নেব নীরব প্রেমে, বিদ্রোহে।

তাই বৃষ্টি, এবার না হয় ধরেই যা...
আর ভয় নেই ঝড় অথবা বর্ষাতে
ঘরহীন মানুষ হাঁটতে জানে হাজার পা
কেবল আপন ইচ্ছেটুকুর ভরসাতে(ই)।

রোদ পড়েছে মন খারাপের আস্তিনে
কান্না চিবুক ছোঁয়ার আগেই শুকিয়ে যায়
জীবন ছেড়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই
বাঁচব আমি, বাঁচছি আমি নির্দ্বিধায়।

সোনালি কাবিন- আল মাহমুদ

বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই

দোহাই মাছ -মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর,

লাঙল জোয়াল কাস্তে বায়ুভরা পালের দোহাই

হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোন কবি করেনা কসুর।

কথার খেলাপ করে আমি যদি  জবান নাপাক

কোনদিন করি তবে হয়ো তুমি বিদ্যুতের ফলা,

এ-বক্ষ বিদীর্ণ করে নামে যেন তোমার তালাক

নাদানের রোজগারে না উঠিও আমিষের নলা।

রাতের নদীতে বাসা পানিউড়ী পাখির ছতরে,

শিষ্ট ঢেউয়ের পাল যে কিসিমে ভাঙে ছল ছল

আমার চুম্বনরাশি ক্রমাগত তোমার গতরে

ঢেলে দেব চিরদিন মুক্ত করে লজ্জার আগল

এর ব্যতিক্রমে বানু  এ -মস্তকে নামুক লানৎ

ভাষার শপথ আর প্রেমময় কাব্যের শপথ।

মানুষের মত- সৃজা ঘোষ

একটা খুশি আমার হয়ে থাকুক
একটা খুশি রাখুক তোমার মন;
একটা খুশি আনুক কোনো হাওয়া
যুদ্ধ মুকুব থাকুক ততক্ষণ।

একটু আলো তোমার নিজের হোক
আর একটু, রোজ আমায় ফেরাক ঘরে
মৃত্যু গুলোর আগেই যেন রোজ
আমরা বুঝি- জীবন পরষ্পরের।

তোমার ভাঙুক সমস্ত ভয়, রাগ
আমিও ঘৃণা এই ফেললাম ছুঁড়ে,
সকল পথ আজ আবার খুলে যাক
তোমার এবং আমার হৃদয়পুরে...

একটা হাসি তোমার মুখে থাক
আর একটা ছাপ ফেলুক আমার ঠোঁটে,
এই পৃথিবীর সকল অভিমান
আবার যেন গোলাপ হয়ে ফোটে।

বাঘিনী- হুমায়ুন আজাদ

বাঘিনীর মতো ওৎ পেতে আছে চাঁদ
ঝাউয়ের মসৃণ ডালে বটের পাতায়/ধ'সে পড়া দালানের ছাদে/
রাস্তায়/ ধাবমান টেলিফোনের তারে/ডাস্টবিনে/
জ্বলজ্বলে নর্দমায়। ব্যগ্র হয়ে ধরা দেয়
ফড়িং/হরিণ/সাপ/মাকড়শা/কাঠবিড়ালি/
নিঅন পেরিয়ে ওড়ে চন্দ্রগ্রস্ত পোকা। এমন ছোবল দিতে জানে
লক্ষবর্ষ পুরাতন নির্মম বাঘিনী।

আমাকে কি ডাক দিলে মিথ্যাভাষী হে বাঘিনী
এ-নিষ্ঠুর চৈতরাতে? মিথ্যে অভিনন্দন বিছিয়ে দিলে
মুমূর্ষু পাতার পংক্তিতে?
তুমি নেই তাই প্রতারণা করার মতোও
                          কেউ নেই এই শূন্য প্রান্তরে।
তোমাকে ধিক্কার দিই/ঘৃণা করি/চড়কষি/
তবু কী ক'রে ভুলি হে বাঘিনী চাঁদ
একদা ছয়ঘন্টা শান্তি দিয়েছিলো সহপাঠী নীলিমা রহমান?

সমুদ্রস্নান- সৃজা ঘোষ

এখনও তোমার খেলাঘরে
আমার সমুদ্র ভেঙে পড়ে।
গড়ে ওঠে বিষাদের বাড়ি
কান্নার গাছ সারি সারি...

এখনো তোমার প্রিয় চাঁদে
আমার রাতেরা একা কাঁদে,
বালি ধরে হেঁটে যাওয়া সার
কোথাও যাওয়ার নেই আর।

এখনো তোমার দেওয়া গানে
শুয়ে থাকি একা- অভিমানে।
এত ব্যথা, জ্বর এসে যায়...
বেঁচে থাকা আজও মৃতপ্রায়।

এখনো তোমার দেওয়া ঘা তে
চোরা বালি খুঁজে ফিরি যাতে
অকপটে ডুবে যাওয়া সোজা
শেষ হলে তোমার হাত খোঁজা।

বৃষ্টিতে মেয়েরা যেমন- সৃজা ঘোষ

একটা মেয়ে মেঘের মুখোমুখি
অন্ধকারে জড়িয়ে গেছে পা,
একটা মেয়ে আকাশ দেখেই সুখী
সেই মেয়েটা বৃষ্টি বোঝে না।

একটা মেয়ের ঝাপসা হাওয়ার চোখ
একটা মেয়ে তাকাচ্ছে না মোটে
একটা মেয়ে নিথর শ্রাবণ মাসে
কাঁদতে গিয়েই বৃষ্টি হয়ে ওঠে৷

একটা মেয়ে বিদ্যুতে ঝলসানো
ভালবেসেই হারিয়ে ফেলে চোখ।
একটা মেয়ে জানলা খুলে দিয়ে
চাইছে বোধহয় একটু আলো হোক

একটা মেয়ে ঘুমিয়ে গেছে কবেই
ছেড়ে আসার বিভৎস সন্ধ্যায়;
একটা মেয়ে সোঁদা মাটির মত
সেই মেয়েটা বিষের অপেক্ষায়...

সমস্ত মেয়ে বৃষ্টি হতে চায়
একটুখানি বৃষ্টি হতে চায়...

অক্ষমতা- সৃজা ঘোষ

বিস্তর পুড়ে গেছ জানি।
কাঁটায় কাঁটায় শুধু
দুঃখকে গাঢ় করে আনি...

ভরসারা ঢেকে গেছে ঘায়ে,
পারিনি রাখতে মুখ
রক্ত ঝরেছে পায়ে পায়ে।

সামনে দাঁড়িয়ে ওরা
অসম্মানের ঢেউ-এ
ভেঙে গেছে আগাগোড়া!

পারি নি গুঁড়িয়ে দিতে,
বিশ্বাসঘাতকেরা
এসেছে অতর্কিতে।

যখনই পেয়েছি ভয়-
সততার অবয়ব
দেখেছি কি দৃঢ় হয়!

ক্ষতর মধ্যে তাই
যতদূর পারি আমি
চেঁচিয়ে বলতে চাই

যতদিন বেঁচে আছি,
থেকে যেতে চাই শুধু
শেষ আলোর কাছাকাছি।

মাধবীকে- দীপক রায়

তিরিশ বছর আগের চিঠিগুলি রেখে দিয়ে কী আনন্দ পাও তুমি!
মাধবী, তোমার নামটাই কীরকম ম্লান হয়ে গেছে।

এখন কি মেয়েদের গীতা বা দুর্গা নাম রাখা যায়?
কতবার বলেছি তোমাকে, চিঠিগুলো নষ্ট করে দাও।
পুড়িয়ে ফেলতে না পার, ভাসিয়ে দাও অলকানন্দায়।

শোনো মাধবী, বদলে যাচ্ছে সবকিছু, নিজেকে বদলে নাও তুমিও।
তোমার নাম বদল করতে বলছি না।
তোমার লম্বা চুল ছেঁটে ফেলতে বলছি না।
শাড়ি বদলে ছোটো পোশাক--তাও বলছি না।
গান শুনতে ভালোবাস তুমি, তোমাকে গীতা ঘটক কিনে দেব।
আসলে আমি নিজেও জানি না, কী বলব তোমাকে?

ওই চিঠিগুলো নিয়ে কথা হচ্ছিল। ওই চিঠিগুলোতে
আমার তাপউত্তাপ আমার লজ্জা আমার দুপুর বিকেল
চিঠিগুলো নষ্ট করে দাও মাধবী।