Monday 27 July 2020

কে এসেছে- জয় গোস্বামী

এই আকাশের নীচে, এই জল মাটিতে কাদায়, খালি পায়ে
আমরা কয়েক পা এসো হাঁটি

দাঁড়ালে, দাঁড়িয়ে পড়তে পারো
যেতে ইচ্ছে করো যদি তোমার শরীর আর তোমার ঠিকানা
অপর কারোর কাছে যাক

এ-জল মাটির মধ্যে, এই আলপথে, এই দশ-বারো লাইন লেখায়
আমার হাঁটার পাশে তোমার পায়ের ছাপ থাক

(কবিতাংশ)

সরোদ বাজাতে জানলে- পূর্ণেন্দু পত্রী

আমার এমন কিছু দুঃখ আছে যার নাম
তিলক-কামোদ
এমন কিছু স্মৃতি যা সিন্ধুভৈরবী
জয়জয়ন্তীর মত বহু ক্ষত
রয়ে গেছে ভিতরে দেয়ালে
কিছু কিছু অভিমান
ইমন-কল্যাণ।
সরোদ বাজাতে জানলে বড় ভাল
হতো।
পুরুষ কীভাবে কাঁদে সে-ই শুধু জানে।
কার্পেট সাজানো প্রিয়
অন্তঃপুরে ঢুকে গেছে জল।
মুহুর্মুহু নৌকোডুবি, ভেসে যায়
বিরুদ্ধ নোঙর।
পৃথিবীর যাবতীয় প্রেমের
সপ্তডিঙা ডুবছে যেখানে
সেখানে নারীর মত পদ্ম ফুটে থাকে।
জল হাসে, জলতার চুড়িপরা হাতে,
নর্তকীর মত নেচে ঘুরে ঘুরে ঘাগরার
ছোবলে
সবকিছু কেড়ে নেয়, কেড়ে নিয়ে ফের
ভরে দেয়
বাসি-হয়ে-যাওয়া বুকে পদ্মগন্ধ,
প্রকাণ্ড উদ্যান।
এই অপরূপ ধ্বংস, মরচে-পড়া ঘরের-
দোরে চাঁপা রঙে এই চুনকাম
দরবারী কানাড়া এরই নাম ?
সরোদ বাজাতে জানলে বড় ভাল
হতো।
পুরুষ কীভাবে বাঁচে সে-ই শুধু জানে।

Sunday 26 July 2020

শুভরাত্রি- লেখা মেঘ -৯ - জয় গোস্বামী

Send me the words 'Good Night' to put under my pillow.

প্রেমিকাকে অনুনয় করেছিলে, মৃত্যুর এক বছর আগে
একফালি কাগজে শুধু 'শুভরাত্রি' লিখে
যেন সে পাঠায়, তুমি
বালিশের নীচে নিয়ে শোবে।

এখন রাত্রির দিকে তাকালেই দেখি
তোমার ফুসফুস থেকে জ্বলন্ত কয়লারা বার হয়ে
আকাশে আকাশে জ্বলছে!
জ্যোৎস্নারা ঠিকরে পড়ছে সকল গাছের পাতা থেকে

শুধু 'শুভরাত্রি' লেখা এক খণ্ড মেঘ
চাঁদের তলায় এসে থেমে গেল।
ও বোধহয় জানে
তোমার ঘুমন্ত দেহ শুয়ে আছে চাঁদে মাথা রেখে!

আষাঢ়- জয়াশিস ঘোষ

হঠাৎই সন্ধে হল। বৃষ্টিতে ভেসেছে প্রশ্রয়
যে কথা কাছের ছিল তাকেও দূরের মনে হয়

রাস্তায় লোক নেই। অভিমান জমেছে কাজলে
আদরের অধিকার মুঠো খুলে ভাসিয়েছি জলে

আলোর হদিশ নেই। আলোকবর্ষ খুঁজে ফেরা
তোমার চুলের থেকে আকাশও নিয়েছে আন্ধেরা

ধুয়ে যাক বালিয়াড়ি, ঠান্ডা কফির চোরা দাগ
এমন অমোঘ দিনে বেপরোয়া ভেঙে যাক বাঁধ

হিসেব বকেয়া থাক।  আমাদের  পায়ে পায়ে ঢেউ
কথার বরফ কাঁধে চুপিসারে পালিয়েছে কেউ

আমাদের কথা নেই,  আমাদের কথারা ভেসেছে
শহরে তারাই ভেজে যারা একবার ভালোবেসেছে

চিহ্ননাম- জয় গোস্বামী

আমি তো কাঠের মতো ভালো লোক।
ঘুণধরা সম্ভব আমাতে।
আমি তো লোহার মতো স্থাণু লোক
মরচে পড়ে যায় সহজেই।

অথচ তুমি তো দেহ
দান করেছিলে এই হাতে।
বলেছিলে, সুরক্ষিতা,
গর্ভসঞ্চারের ভয় নেই।

কেন ভয় ছিল না তোমার?
কেন তুমি রাখলে না
গোপনে আমার চিহ্ন, নাম?
কেউ জানতে পারত না,
শুধু আমরা দু'জনে জানতাম!
কত দেরি হয়ে গেল,
এখন সময় নেই আর।

(কবিতাংশ)

বিশ্বাস- অরণি বসু

হাসতে হাসতে তুমি আমার হাত ধরো
হাসতে হাসতে আমি তোমার হাত ধরি
তবু চোখে জল কেন?

পুড়িয়ে পুড়িয়ে মৃতপ্রায় করে নেমে এসেছে
আকাশ উপুড় করা বৃষ্টি।
তবু চোখে জল? তোমার? আমার?

নিশিদিন সঙ্গীতবিহীন তুচ্ছতায় ভরা...

লাবণ্যের কাছে এসো আজ করজোড়ে বসে থাকি,
অনন্তর কাছ থেকে চেয়ে আনি একবাটি বিশ্বাস।

ডুব- জয়াশিস ঘোষ

আলোর দুষ্প্রাপ্যতায় তোমাকে মনে পড়ে।

মনে পড়ে জলের অন্ধকারে তুমি হাত ধরতে চেয়েছিলে
জ্বরে আমার মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। বিঠোভেন
বাজাচ্ছিলেন আশ্চর্য সিম্ফনি

অন্ধকার ভেঙে ভেঙে আমার মুখে ভরে দিচ্ছিলে
ওষুধ ভেবেছি
তাই ক্ষত থেকে ছিঁড়ে ফেলেছি জোনাকির পাখনা

এই দেহতাপ, যতই কবিতা মনে হয়
আসলে
অন্ধকারে ডুবে থাকা জুন মাস। স্নায়ুছেঁড়া দূরত্বে
খেলা করে প্রিয় পিছুটান

আলো কমে এলে দেখি লালারসে মুছে গেছে
                                              হত্যার প্রতিটি প্রমাণ

দ্বা সুপর্ণা- শঙ্খ ঘোষ

'কেমন করে পারো এমন স্বাভাবিক আর স্বাদু আহার
সব জায়গায় মানিয়ে যাও কিছুই তোমার নিজস্ব নয়
কেমন করে পারো?
নষ্ট তুমি নষ্ট তোমার আলগা শোভা বুকের বাহার
সমস্ত ফল ঠোঁটে জ্বালাও সবার সঙ্গে সমান প্রণয়
কেমন করে পারো?'

'নষ্ট আমি কিছুই আমার নিজস্ব নয় ; ডালে-ডালে
পাতায়-পাতায় স্বাদু আহার বিষ অথবা বাঁচার আগুন
ধরে ব্যাপক মাটি--
দীর্ঘতর বট, এমন জটিলঝুরি সমকালীন
সব জায়গায় থাকি, আমার
অন্য একটি পাখি কেবল আড়াল করে রাখি।'

সন্দেহ- অরণি বসু

তুমি হয়তো অন্য কাউকে ভালোবাসো, ভালোবাসতেই পারো--
সেটা তেমন কোনো সমস্যা নয়,
সমস্যা এই যে,
গরমকালে আমি ল্যাম্পোস্টের আড়ালে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকি
                                        তোমার অভিসারের সম্ভাব্য পথে,
শীতকালে র‍্যাপার মুড়ি দিয়ে অনুসরণ করি তোমায়।
গুজবে নড়ে হাওয়া, হাওয়ায় লাগে আগুন--
আগুনে আমি নিজেকে পোড়াই, তোমাকে পোড়াই আর

ধিক ধিক করে জ্বলতে থাকে আমাদের পৃথিবী।

সিল্যুয়েট ৪- জয়াশিস ঘোষ

প্রতিবার হাসপাতালে এলে আমি অন্ধ হয়ে যাই।
এত আলো আমাকে অমর করে তোলে। চারধারের
কান্নাধ্বনির মাঝে একরোখা এসরাজের শব্দ শুনি।
অথচ এই সময় আমার তোমাকে ছুঁয়ে থাকার কথা!
পালক হয়ে যাই। ওই জেদী মেয়েটার কপাল থেকে
ঘুরে আসি।
সেই মেয়েটা, মৃতদেহ ছেড়ে যে উঠে যায়নি
বৃষ্টিতে....

জল- অরণি বসু

তোমার বুকের ভিতর যতটা আগুন আছে
আমার ভিতরে ততটা জল নেই আজও।
কীভাবে জুড়াই তোমাকে-
কীভাবে শান্তি দিতে পারি-
ভাবতে ভাবতে রাস্তায় নেমে আসি,
পথে পথে খুঁজে বেড়াই জল।

শুধু তোমার পাশে পাশে থাকব বলে।

বোকা মানুষের চিঠি ৪- জয়াশিস ঘোষ

শহরে উদাসী হাওয়া।  মনের ভেতর শিরশির
কত কী বলেছে কানে, প্রেমিকেরা জন্মবধির

তোমার চোখের নীচে অসংখ্য কবিতার বাস
স্নান সেরে কাছে আসো আমার বিষাদবিলাস

যতবার কাছে যাই তোমাকে নতুন করে দেখি
এমন হাসির কাছে পৃথিবীর সব সুখ মেকী

রুক্ষ শীতের রাতে দরজায় বেঁধে নাও খিল
জেনেছ কার নামে বেজেছে গোপনীয় তিল?

একটু আগুন ঘিরে বসে আছে চার পাঁচ লোক
সন্ধের ফাঁকা বাসে বাড়ি ফেরে বেহালাবাদক

সামান্য আঁখিপাত শীতের সন্ধে দিয়ে কেনা
আমি যদি চাতক হই, তুমিও কি জল দেবে না?

অবৈধ- অরণি বসু

আমার জন্যে নয়, ওই মোমবাতি জ্বলেছিল অন্য কারও জন্যে
আমি ঘটনাচক্রে তার কাছাকাছি এসে উত্তাপ নিয়েছি।

আমার জন্যে নয়, ওই মোমবাতি জ্বলেছিল অন্য কারও জন্যে
আমি সন্তর্পণে আমার মুখে তার আলো মাখিয়ে নিয়েছি।

টুকরো জয়াশিস

*তাকে দায়সারা ভাবিনি কখনও
শুধু শেকলে বেঁধেছি তার দায়
স্পর্শ ছিঁড়ে গেলে কতটা অসুখ বোঝা যায়!

*বহুকাল কথা নেই। অস্ফুটে  গলে গেছে মোমও
যাকে তুমি ভালোবাসো, তার কাছে ভেঙেছ কখনও?

*আমাদের কথা নেই। আমাদের কথারা ভেসেছে
এ শহরে ভেজে তারা, যারা একবার ভালোবেসেছে

*নিছক কাঁচের টিপ। টেবিলে ছড়ানো থোকা স্মৃতি
বৃষ্টি প্রবল হলে ফেলে চলে যাওয়াটাই রীতি...

*সিল্যুয়েট ১

পাথুরে জমিতে
হোঁচট খাবো
'তুমি'র খোঁজে আমি আমরণ ভিজে যাবো
সম্পর্কের কাছে রেখে যাবো বেহায়া বটগাছ..
(কবিতাংশ)

*চুম্বন

দৌড়ে এসো! ওড়াও এলো চুল
তারে তারে জড়িয়ে গেছে গাছ
আমার ঠোঁটে রাখতে পারো ভুল
অথবা ঐ কঠিন ভ্রূর ভাঁজ!
********
হাতের ভেতরে শক্ত করে হাত
ঠোঁটের ওপর আছড়ে পড়ুক শোকে
চুমুবিহীন শহর নিপাত যাক
কালকে যেন গল্প করে লোকে!

(কবিতাংশ)