Friday 18 September 2020

প্রেমের ক্ষমা - আবুল মকসুদ

যেমন চাঁদের জন্য চাই একটি আকাশ
তেম্নি হৃদয়ের জন্য নিঃসীম ভালবাসা,
ফসলের জন্য বন্ধ্যামাটিতে প্রয়োজন
শিল্পীর মতো তিতীষ্ণু এক চাষা;

সখী, চাঁদ যদি রাখো হাঁড়ির ভিতরে বন্দী
কেউ কি জানবে কত সীমাহীন তার প্রতিভা,
এ হৃদয় যদি কারো নাহি বাসে ভালো
তুমি বলো :  আহা কার কি তাতে ক্ষতি বা!

ভীষণ যে ক্ষতি বুঝবে না তুমি কোনোদিন,
বক্ষ তোমার বন্ধ্যামাটি কালো উপমা,
ভালোবাসা ছাড়া হৃদয় যে শুধু অর্থহীন
সেটাই বুঝতে তোমাকে করেছি প্রেমের ক্ষমা।

ভালবাসা যাযাবর- তরুণ চট্টোপাধ্যায়

ভালবাসা মানে এমন তো নয়, শুধু প্রেম প্রেম খেলা,
ভালবাসা মানে বাসনা-কুসুম একে একে ছিঁড়ে ফেলা।
ভালবাসা মানে এই নয় শুধু দাঁত দিয়ে মাড়ি কাটা,
ভালবাসা মানে কাঁটার ওপরে রক্তাভ হয়ে হাঁটা।
ভালবাসা মানে এই নয় শুধু রঙে রঙে হোলি খেলা,
ভালবাসা মানে স্বপ্ন অভ্রে হৃদয় রাঙিয়ে তোলা।
ভালবাসা মানে এই নয় শুধু প্রেমহীন মৈথুন,
ভালবাসা মানে লুকানো কবিতা মনে সেতারের ধুন।
ভালবাসা মানে এই নয় শুধু জ্যোৎস্নায় গান গাওয়া।
ভালবাসা মানে ফুলের মতন নিঃশেষে ঝরে যাওয়া।
ভালবাসা মানে এই নয় শুধু হাতে হাতখানি রাখা।
ভালবাসা মানে হৃদয় বেদনা মনের গভীরে ঢাকা।
ভালবাসা মানে শুধুই দুজন? বাকি আর সব পর?
ভালবাসা মানে সবাই আপন তুমি আমি যাযাবর।

টিয়া- বিকাশ গায়েন

যাকে ছেড়ে গিয়েছিলে তাচ্ছিল্য মাখিয়ে
সে কবেই ঠাঁই পেয়ে গেছে অন্যমনে।
তোমাকে না ভোলা তার চিরস্থায়ী হয়ে থাক
আজও তুমি ভেবে যাও অশ্রুর বিজনে।

ছেড়ে ছিলে যদি তবে কেন এত দ্বিধা ভুলে যেতে?
বিমুখ করার ছলে আসলে তুমিও তাকে
চেয়েছিলে পেতে।
সকলেই ভারে কাটে, কজনই বা ধারে!
নিরাপত্তা সুনিশ্চিত,
এইবার ঝুঁকি নিয়ে দেখা যেতে পারে?

শেষ কথা বলেছিলে, আরও কিছু ছিল তবে বাকি!
আকাশ পরিধি জুড়ে উড়ছে স্মৃতির টিয়াপাখি।

একটি কথার মৃত্যুবার্ষিকীতে- অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

তুমি যে বলেছিলে গোধূলি হলে
সহজ হবে তুমি আমার মতো,
নৌকো হবে সব পথের কাঁটা,
কীর্তিনাশা পথে নমিতা নদী!
গোধূলি হলো।

তুমি যে বলেছিলে রাত্রি হলে
মুখোশ খুলে দেবে বিভোর বিভা,
অহংকার ভুলে অরুন্ধতী
বশিষ্ঠের কোলে মূর্ছা যাবে!
রাত্রি হল।

তুমি জানলে না- প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়

যে-কোনও ছুতোয় আমি একদিন অভিমান করে
সব কিছু ছেড়ে চলে যাব,
তোমার ঘুমন্ত মুঠি তাই কি এভাবে ধরে রাখে
বসনের খুঁট? তুমি ভাবো,
দিগন্তের অন্ধকার হঠাৎ বন্ধুর মতো যদি অবিকল নাম ধরে
কোনওদিন ডাকে,
তুমি ফেরাবে আমাকে।

নিশি-পাওয়া মানুষেরা কত দূরে যায়? যেতে পারে?
আমি তারও চেয়ে বহু দূর
যোজন-যোজন পথ পার হয়ে যাই। রুক্ষ, অচেনা, কঠিন,
প্রতি রাত্রে অদ্ভুত বন্ধুর
দিগন্তের কাছাকাছি, দিগন্ত ছাড়িয়ে, শূন্য নির্জন আঁধারে
নিরালম্ব, আশ্রয়বিহীন।

তুমি জানলে না, কোনওদিন।

Thursday 17 September 2020

Sunday 13 September 2020

বসন্ত নয় অবহেলা- দর্পন কবির

বসন্ত নয় আমার দরজায় প্রথম কড়া নেড়েছিল অবহেলা।
ভেবেছিলাম অনেকগুলো বর্ষা শেষে শরতের উষ্ণতা মিশিয়ে এলো বুঝি বসন্ত!
দরজা খুলে দেখি আমাকে ভালোবেসে এসেছে অবহেলা।
মধ্য দুপুরে তীর্যক রোদের মত অনেকটা নির্লজ্জের মত আমাকে আলিঙ্গন করে নিয়েছিলো অনাকাঙ্ক্ষিত অবহেলা।
আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখেছিলাম আমার দীন দশায় কারো করুণা বা আর্তিব পেখম ছড়িয়ে আছে কী না!
ছিলো না।
বৃষ্টিহীন জনপদে খড়খড়ে রোদ যেমন দস্যুর মত অদমনীয়
তেমনি অবহেলাও আমাকে আগলে রেখেছিল নির্মোহ নিঃসঙ্কোচিত।

আমি অবহেলাকে পিছনে ফেলে একবার ভো-দৌড় দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম।
তখন দেখি আমার সামনে কলহাস্যে দাঁড়িয়েছে উপেক্ষা।

উপেক্ষার সঙ্গেও একবার কানামাছি খেলে এগিয়ে গিয়েছিলাম তোমাদের কোলাহল মুখর আনন্দ সভায়।
কী মিলেছিলো?
ঠোঁট উলটানো ভৎসনা আর অভিশপ্ত অনূঢ়ার মত একতাল অবঙ্গা।
তাও শয়ে গিয়েছিলাম একটা সময়।

হ্যাঁ একবার তুমি বা তোমরা যেন দয়া করে বাঁকা চোখে তাকিয়েছিলে আমার দিকে।
তাচ্ছিল্য নয় একটু মায়াই যেন ছিল,
হতে পারে কাঁপা আবেগ ও মিশ্রিত ছিল তোমার দৃষ্টিতে।
ওইটুকুই আমার যা পাওয়া।

আমি ঝরে যাওয়া পাতা,
তুমি ছিলে আকষ্মিক দমকা হাওয়া।
তারপর ও অবহেলার চাদর ছাড়িয়ে উপেক্ষার দেয়াল ডিঙ্গিয়ে ও অবহেলার লাল দাগ মুছে জীবনের কোনো সীমারেখা ভাঙ্গতে পারিনি আমি।
একথা জানে শুধু অন্তর্যামী...

Sunday 6 September 2020

সে তোমাকে পাবে না- মইনুল আহসান সাবের

তোমার পুরুষ সে তো জানেনা, মাঝ রাতে বৃষ্টি হলে কেন তুমি ভেসে যাও
কে তোমায় বাজায় তখন,

কার কন্ঠে গান গায় একান্তের স্মৃতি,
কোন সে হাত এসে সিঁথি কাটে তোমার চুলে,
তোমাকে শয্যা থেকে তুলে নেয়,

তোমাকে তোমার শরীর থেকে তুলে নেয়,
কোন সে পুরুষ?

তোমার পুরুষ সে তো জানেনা, বোঝেনা, মাঝ রাতে বৃষ্টির অর্থ,
জানেনা নির্জন করিডোরে নতজানু এক নিঃসঙ্গ যুবক,
তোমাকে মাঝরাতে বৃষ্টির কথা বলেছিল,
তোমার চমকিত চোখে বরিষন দেখেছে সে,
বলেছিল- তোমার নিজস্ব পুরুষ; সে তো জানেনা,
নিজস্ব ছাড়িয়ে আরো কিছু থাকে।

আগুনে পোড়াব- কৃষ্ণা বসু

আগুনে পোড়াব তোর স্মৃতি , জলে ভাসাবো না ,
আগুনে সমস্ত খায় ,
স্মৃতি খায় , সর্বস্বতা খায় , জৈব চুম্বকের মতো
যেই শরীরের কাতরতা , তা -ও খায়
আগুন সমস্ত খেয়ে ছাই ফেলে রাখে !
ছাইয়ের নিজস্ব কোনো অবয়ব নেই
উদলা হওয়ায় হু হু ছাই উড়ে যায়
হৃদয় শ্মশান হোক ! সব স্মৃতি পুড়ে যাক তোর
শ্মশান হৃদয় নিয়ে একা জেগে থাকি ,
নদী তীরে নিরালায় পবিত্র একাকী !
জলে ভাসাবো না তোর স্মৃতি
জলের অপর নাম জীবন ,জেনেছি !
জলের সারল্যে ফের জেগে উঠতে পারে
তোর স্বয়ংভরা স্মৃতি
তাই জলে ভাসাবো না ,---
আগুনে পোড়াবো তোর স্মৃতি !

পাখি- বিজয়া মুখোপাধ্যায়

যে পাখি বুকের ভেতরে থাকে, তার
কোনও-না-কোনও ডানায় কেন বারবার
আঘাত লাগাও? তাকে শুশ্রূষা করোনি কখনও
মন দিয়ে?

আজ তার আহত ডানায় বুলিয়ে দাও হাত
সাফ করে দাও ওর ধুলোবালি, সংক্রমণ
কাছে থাকো, ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখো ওর বুকের ধুকপুক।
ধীরে ধীরে সুস্থ করে তোলো ওকে
তার পর ছেড়ে দাও আকাশে
না-ফেরার স্বাধীনতা দাও
সালিম আলি অন্ধকার থেকে তোমাকে স্নেহ জানাবেন।

তার পর
অর্ধজন্ম তুমি কাটিয়ে দাও পাখিহীন
কষ্ট নাও বুকে
তোমার নতুন জন্ম হোক।

পাতা ঝরে গেলে- কালীকৃষ্ণ গুহ

পাতা ঝরে গেলে
তবু তুমি ছায়ার ভিতর দাঁড়িয়ে থাকো
রুগ্ন পবিত্রতা।

পাতা ঝরে গেলে
বুকের ভিতর কান্না তুমি গোপন করে রাখো
ছিন্ন করো কথা?

পাতা ঝরে গেলে
কুয়াশা তোমার জীবনের নীচে নেমে যায়, তবু ঢাকো
মুখ। সে কি সবই পাতার বিষণ্ণতা?

৫.৭.৬৬

Monday 31 August 2020

আমি তোমায় গোলাপ দেব-মাইনুল এইচ সিরাজী

টবটা রাঙিয়েছি সবুজ রঙে। সবুজ টবে কী ফুল ফোটাব? কেন, লাল? তাহলে গোলাপই হোক। গোলাপ ছাড়া কোন ফুলে আর মানাবে তোমায়? লাল ছাড়া কোন রঙে আর রাঙাব তোমায়? সুতরাং তোমার জন্য গোলাপ। সবুজ টবে লাগিয়েছি। আমার জানালার পাশের বারান্দায়। প্রতি সকালে টবটা আমি সরিয়ে দিই আলোর দিকে। প্রতি বিকেলে জল ঢালি আমি গোলাপ চারায়। আর সারা দিনমান, দুপুর কিংবা সন্ধ্যাগুলোয় অথবা রাতবিরাতে আমার বুকের গভীরে গজিয়ে ওঠা আরেকটি গোলাপের গাছের যত্ন নিই আমি। অতি আদরে। ভালোবাসায়। গোলাপের কাঁটায় আমার হৃৎপিণ্ডে রক্তক্ষরণ হয়। ডালপালা ছড়িয়ে যায় আমার সারাটা অস্তিত্বে। এই আমি হয়ে যেতে থাকি আস্ত একটা গোলাপগাছ। তোমার জন্য। আমার সবুজ টবের গাছটাও বাড়তে থাকে। ডালপালা ছড়ায়। চলে ফুল ফোটানোর আয়োজন। তোমার জন্য।আমার অপেক্ষার প্রহরগুলো ছড়িয়ে পড়ে জলে-হাওয়ায়, কখনো বা ডালপালা আর পাতায় পাতায়। তোমার সাড়া পাওয়ার অপেক্ষা অথবা অপেক্ষা গোলাপ ফোটার। কিংবা দুটোরই।তুমি আসবে বলেছিলে। না, বলোনি। তোমার ভেজা চোখে, নোয়ানো পাপড়িতে, তোমার কম্পমান ঠোঁটে প্রশ্রয়ের মায়া দেখেছিলাম আমি। তাই তো বুনেছি সবুজ টবে গোলাপের চারা।আসবে তুমি। কোনো মিথ্যে নেই। সবুজ শাড়িতে গোলাপি মুখাবয়ব ফুটে উঠবে তোমার। তোমাকে নিয়ে যাব বারান্দায়। হাত ধরে। যেখানে আমার গোলাপ অপেক্ষায় আছে। ফোটার জন্য। তোমার জন্য। তোমাকে নিয়ে রাখব বুকের মাঝে। যেখানে রক্তক্ষরণ হচ্ছে বহুদিন। তোমাকে দেখার পর থেকে। চুড়িতে-নূপুরে টুংটাং শব্দ তুলে আসবে তুমি। সেই শব্দে পাপড়ি মেলবে আমার গোলাপ। সেই শব্দে বন্ধ হবে বুকের রক্তপাত। ...অতঃপর আমার প্রতীক্ষা নীল হয়ে ছড়িয়ে যায় আকাশে আকাশে। ভালোবাসাও। আমার গোলাপটা ঝরে যায়। বিবর্ণ হয়ে যায় টবের সবুজ। রক্ত ঝরে ঝরে অনুভূতিশূন্য হয়ে যায় বুকটা। না-ই বা যদি আসবে, কেন তবে ঠোঁট কাঁপালে? পাপড়ি নোয়ালে? না-ই বা যদি আসবে, কেন তবে চোখ ভেজালে?

প্রকাশ: ৭ এপ্রিল ২০১৩ (প্রথম আলো- বন্ধুসভা)

https://www.bondhushava.com/আমি-তোমায়-গোলাপ-দেব

Saturday 29 August 2020

রূপান্তর- শামসুর রাহমান

চঞ্চলা নর্তকী নও, অথচ যখন হাঁটো কিংবা ছুটে যাও,
বর্ষার বৃষ্টি পরে রামধনু উঠলে আকাশে,
বারান্দায়, চলায় সহজে লাগে ছন্দের বিদ্যুৎ।
যখন আয়নার সামনে লিপস্টিক মাখো ঠোঁটে, হাই-হিল জুতো
পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামো, হাতে বই, বুকের উপর
কালো বেণী, চিবুকে ঘামের ফোটা, কী-যে ভালো লাগে।

যখন বাগানে যাও, ফুল তোলো, ঝকঝকে দাঁতে
হঠাৎ কামড়ে ধরো সবুজ পেয়ারা, ময়নাকে
ছাতু দাও খেতে আর ভাঁড়ারের অন্ধকার কোণে
আঁতকে ওঠো আরশোলা দেখে, পানি চেয়ে
ভেঙে ফ্যালো গ্লাস, নখ খাও এবং চাবির রিং
ঘোরাও আঙুলে
অথবা সুরের তাল কেটে গেলে তন্ময় বিকেলে
খিলখিল ওঠো হেসে, ক্যারম খেলতে গিয়ে সারা
খেলাটাই করো মাটি
কী ক’রে বোঝাই কত ভালো লাগে তোমাকে তখন।

অবশ্য কখনো কবিতা পড়ো না তুমি (ক্লাসের বরাদ্দ পদ্য ছাড়া)
তাতে কী? তবুও এ সুন্দর শরীরী সৌরভে মেতে
চেনা পৃথিবীতে আছো তাই মেটাই চোখের তৃষ্ণা সারাক্ষণ।

হয়ত পারতে হ’তে সোনালি-নিবিড় বালুকণা।
আমার মুঠোয় ঝলোমলো, ভাবি তুমি অর্গানের
ধ্বনির মতোই শ্রাবণের কালো ফোটা পাতাবাহারের বুকে,
বাগানের টসটসে ফলের সুরভি, মাংসে-বেঁধা
গোলাপের কাঁটা পারতে হ’তে...