তোমাকে প্রেম,
অথচ তুমি এলে ভাল হবে। আমার দোতলার ঘরটা এবার নতুন করে সাজাবো। লেখার জায়গায় ফ্লাওয়ার ভাস, কর্নার টেবিলে একটা হলুদ আলোর ল্যাম্পশেড, সোকেশে একটা সুগন্ধী মোম। প্রিয় জানলাগুলোর জন্য নতুন পর্দা কিনব। হাওয়ায় ওড়া, অবাধ্য, রঙীন ফুল আঁকা পর্দা... সারাদিন উড়বে সে। আমি বুঝব নতুন হাওয়া এলো আমার জন্যে...
তুমি এলে বাবার সেই কবেকার দেওয়া খালি পড়ে থাকা ডায়েরিটা সদ্য কিশোরীর মত ভরিয়ে ফেলব। একটা নতুন নিব পেন চাই কিন্তু। কাউকে ধরতেই দেব না আমার ডায়েরি। ভেতরের পাতায় যা ইচ্ছে, পেছনের পাতায় লুকোনো কাটাকুটি। আর ওপরে? গোটা গোটা হরফে লিখব 'গোপন'। শব্দটাকে ঘিরে দুটো জড়িয়ে যাওয়া লতা আঁকব...
ঠিক সময় ঘুমোবো তুমি এলে। অন্ধকার আমাকে মুখ ভেঙানোর আগেই আমি অন্ধকারকে ভেংচি কাটব। তোমার সাথে কথার ফাঁকে কখন চোখ লেগে আসবে, নিজেই জানব না। ঘুমের মধ্যে থেকে থেকে কেঁপে উঠবে না একজন। কেন বলোতো? তখন যে ভয়ের কিচ্ছু থাকবে না, ভোলার কিচ্ছু থাকবে না... লক্ষ্মী মেয়ে কাকে বলে জানো? ঠিক তেমন হবো আমি।
তুমি এলে অল্প সাজব। টিপ, দুল পরি না বলে আর শুনতে হবে না মায়ের বকাবকি। যে মেয়েটা সাজ বলতে শুধু ডার্কসার্কেল সামলানো কাজল বোঝে, সে হুট করে একদিন প্রজাপতি হয়ে যাবে তুমি এলে। সব্বাই হাঁ হয়ে যাবে কিন্তু!
তুমি এলে গানটা নিয়ে বসব, বুঝলে? বাড়ির লোকের আর আফসোস থাকবে না ভাল গলাটা নষ্ট করছি বলে। গীতবিতান তো কাছেই থাকে, শুধু গান দেবার মত মানুষ থাকে না। যদি আসো, তখন তুমিই আমার ঘুম ভাঙানিয়া, তুমিই দুঃখজাগানিয়া। আর এইবার গোটা বাড়িতে সুর ঘুরে বেড়াবে পায়ে পায়ে। তবু আমার হিয়া বিরাম পায় না যে!
যা যা কিছু পারি অথচ অভিমানে করিনি এতদিন, সেসব করব এইবার। ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরব। এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ানোর প্রয়োজনই হবে না। আর আমার কোলকাতা অবসেশন? সেও নাহয় তোমার সঙ্গেই হবে। ছুটি হলে ঘাট... নৌকো... হাওয়াই মিঠাই... হলুদ ট্যাক্সি... শীতে বইমেলা... মৌড়ি লজেন্স...মিউজিয়াম... ফাঁকা রাস্তা... আইসক্রিম... বাংলা সিনেমা... কফিশপ... তুমি এলে, এ শহরের যা যা কিছু আমার একার, সব আধাআধি হবে কেমন? আচ্ছা... আধাআধি না, তোমায় একটু বেশিই দেব। ভালবাসলে ভাগ করতে নেই। যা তোমার তাই আমার।
তুমি এলে এবার একটা গান আর একটা গল্প লিখব। প্রেমের। পাঠক চায় খুব, আমিই এতকাল পারিনি প্রেমের অভাবে। এবার সত্যি লিখব। লিখেই তোমায় পড়াবো, তারপর ছড়িয়ে দেব। কপিরাইট রাখবনা। আমি চাই এ শহরে প্রেমের গান আর প্রেমের মানুষ বারবার চুরি যাক
এই যাহ! কাজের কথাই বলা হল না যে! বসন্ত নিয়ে একটা ফিরিস্তি আছে কিন্তু। শুনে নাও- তুঁতে, হলুদ, গোলাপী আর সিঁদুরে লাল এই চার রঙের আবীর। মনে থাকবে? তুঁতে, হলুদ, গোলাপি আর লাল। ফাল্গুন মাস পড়লেই চাই। না, মোটেই ছেলেমানুষি না। আমার কি দোষ? বসন্তে জন্মানো মেয়ে যে... রাধিকার হোরি নইলে চলে কখনো? অতএব, ফুল ফুটুক না ফুটুক, সেদিন বসন্ত হবে।
তুমি এলে বারোমাস প্রতিবাদ... বারোমাস প্রেম...বারোমাস অঞ্জন সুমন রূপম... একসাথে মিছিলে যাব। দেশ শহর গ্রাম সব তো এক। কোথাও অন্যায় দেখলেই, ধরে থাকা হাতদুটো নিমেষে ব্যারিকেড। প্রতিরোধ সেরে শেষ বাসে বাড়ি ফিরব কাঁধে মাথা রেখে। বাবা বলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানুষ ভাল হয়। তুমিও বাবার মত ভাল হবে। হবে তো?
তুমি এলে ইচ্ছের ছুটিতে তোমার পাহাড়। আর দুঃখে, আমার সমুদ্র। রাগ করলে কপালে সেই বিশেষ স্নেহ আর ভাত খাইয়ে দিলেই চলে কিন্তু তাতেও যদি কাজ না হয়, কোনো কারণে যদি কথা বন্ধ, যদি অভিমান, যদি অসুখ, যদি বিরহ... তবে কিন্তু ছুটি নিয়ে সোজা জঙ্গল- কথা হয়েই রইল। ওখানে রাত নামবে আর দেখবে আমাদের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে আবার সব।
ব্যাস। এটুকুই। একে সুখ বলে সুখ, ঝক্কি বললে ঝক্কি। তুমি এলে এসব সুখ হবে, এসব ঝক্কি হবে। তুমি না এলে এসবের কিচ্ছু হবে না। সহজ হিসেব। তখন আর কি? এই জীবন এই জীবনই রইল। আমি তোমায় পেলাম না আর তুমি পেলেনা এমন একজনকে, যে ছুঁয়ে দিলে সবকিছু ভালবাসা হয়ে যেতে পারত রাতারাতি। তুমি এলে সেসব প্রিয় হবে, না এলে নয়। তখন তোমার না আসা কবিতায় সবাই পড়বে, তোমার না আসার গল্প আমার লেখা হয়ে বিক্রি হবে কলেজস্ট্রিটে। মেটাফর বুঝলে, হুঁ হুঁ, সব কেমন মেটাফর হয়ে যায়...
আমার দোতলার ঘরটা একরকমই থাকবে। ভারি পর্দাটা সরাবে না কোনো হাওয়া। আমার নীল আলো কখনো হলুদ হবেনা আর। আমার ডায়েরি নিয়ে প্রকাশক আর দু একটা বন্ধু ছাড়া কারো কোনও কৌতুহল থাকবেনা। সবাই মিলে আমার সব ডায়েরিকে একদিন বই বলে ছাপিয়ে বার করে দেবে। বইমেলায় বিক্রি হবে সেইসব তোমার অজান্তেই। কোনোদিন কোনো ম্যাগাজিনে এক ছদ্মনামীর লেখা পড়ে হয়ত চমকে উঠবে তুমি! তোমার চেনা চেনা লাগবে সব। হয়ত তোমার আফসোস হবে কিম্বা কিচ্ছু হবেনা। তবে আমার কিন্তু নাম হবে আরও... লোকে সমীহ করবে। শুধু মায়ের কাছে খাওয়ায় ঘুমোনোয় নিজের খেয়াল রাখায় আমার আর এজম্মে লক্ষ্মী মেয়ে হওয়া হবে না।
বয়স বাড়বে। কাজ বাড়বে। একটা বয়সের পর হয় নিয়মিত ঘুমের ওষুধ লাগবে নয়ত দুঃস্বপ্ন সওয়ার জোর। কাজল ছাড়া আর কিচ্ছু থাকবেনা আমার সাজবাক্সে। প্রতিবাদে আর ব্যারিকেড নয় থাকবে ভেতরে ক্লান্ত আর বাইরে শক্ত একটা মুঠো। তোমার ওপর নাকি নিজের ওপর রাগ করে একটা গানও গোটা গাওয়া হবে না আর কোনোদিন। স্নানের ঘর জানবে শুধু প্রেমের গানে, প্রেমের লেখায় আসলে আমি একটা ভাসা ভাসা মুখ খুঁজি। তুমি না এলে আমার কোলকাতা গোটাটা আমারই থাকবে। আমার ছোট ছোট চোখে, মুঠোয় একটা গোটা শহর উপচে পড়বে অথচ তাকে ভাগ করে নেবার মত কেউ থাকবেনা।
তুমি, প্রেম, তুমি না এলে আমার সমস্ত ফাল্গুন শুধু রঙ জমিয়েই কাটবে, সে রঙ ছোঁয়ানো হবে না আর কাউকে। আমি পাহাড় থেকে ছুটি শেষ হবার আগেই ফিরে পড়ব, সমুদ্রে ডুবব তবু দুঃখ ধুয়ে যাবে না কিছুতেই। অভিমান করে লাভ হবে না জেনেও সেদিন যদি কিছু ছেলেমানুষী অভিমান করে ফেলি একাই জঙ্গলে যাব। ওখানে রাত বাড়বে আর আমার গায়ে জ্বর... এই যেমন এখন। লোকে বলবে অসুখ। আমি জানব- অপ্রেম। লোকে বলবে- পাগলামি। আমি জানব- অপেক্ষা।
আসলে- তুমি না এলে অনেক কিছু হবে, তুমি না এলে বহু কিছু হবেনা। তবে যাই হোক। আমি কিন্তু বাঁচতে চাই। এই শহরটার মত... পাওয়া, না পাওয়ার সব ক্যাকাফনি গায়ে জড়িয়ে বাঁচতে চাই। মরতে তো আমাদের সবাইকেই হবে একদিন! ওতে আর নতুন কি বাহাদুরি ? শুধু তুমি এলে আনন্দের বিষে মরব আর না এলে- বিষাদের অমৃতে। তফাত বলতে তো এটুকুই...
ইতি,
আর কে? একটা হতচ্ছাড়া, একটা আধপাগল কিন্তু কোত্থেকে যেন এই বয়সেই ভালবাসার আসল মানেটা ধরে ফেলা এক আস্ত পাকাবুড়ি 😊