এভাবে খেলার কোনও মানে হয় না--
তুমি যে নেশার ঘোরে উল বোনো,
চাঁদা পাও এখানে সেখানে
তারই বা কী মানে?
বেঁচে থাকা যায়, যদি ভাব হয় সমানে-সমানে।।
এভাবে খেলার কোনও মানে হয় না--
তুমি যে নেশার ঘোরে উল বোনো,
চাঁদা পাও এখানে সেখানে
তারই বা কী মানে?
বেঁচে থাকা যায়, যদি ভাব হয় সমানে-সমানে।।
যে তোমাকে ছেড়ে যেতে চায়
তাকে যেতে দাও
আটকে রেখো না।
একটি কথাও না বলে তার
ব্রিফকেস গোছাতে সাহায্য করো।
প্রেসার বা থায়রয়েডের ওষুধ সে যেন
ভুল করে ফেলে না যায়। শূন্যতা ছাড়া
সে যেন ছেড়ে না যায় আর কোনো স্মৃতি।
অশ্রুগ্রন্থি থেকে যেন বেরিয়ে না আসে সূচ্যগ্র তরল
ঘুণাক্ষরেও তোমার মুখে যেন জলবসন্তের মতো
আর্তি আর হাহাকার ফুটে না ওঠে।
শুধু এগিয়ে দেওয়ার পথে নীচু স্বরে বোলো
দরজা ভেজানো থাকবে
টোকা দেওয়ার দরকার নেই।
আলতো ঠেলে দিলেই কপাট খুলে যাবে।
চাইনি, চাইনি
তবু এলো ডাইনি
বললো সে, কতোকাল
তোকে আমি পাইনি,
মনের মতন তরিযুত ক'রে খাইনি।
খাচ্ছে সে, খাচ্ছে,
বহুরূপী ভগবান নিজেকে বাঁচাচ্ছে,
স্থান-কাল-পাত্ররা সবাই পালাচ্ছে...
রেগেমেগে আমি আর নিজেকে বাঁচাইনি।
অতিক্রম করে যাওয়া শিল্পের নিয়ম
ঘুঁটের ছাপের মতো
ক্ষতচিহ্নে ছেয়ে গেছে জীবন, সময়
রক্তের জানালা ভেঙে
তবু সূর্যোকরোজ্জ্বল বাঁশি ডেকে যায়
ঝড়ের রাতের অভিসারে।
অতিক্রম করে যাওয়া
জীবনেরও নিশ্চিত নিয়ম।
পাহাড়ের চুড়োগুলো অতিক্রম করে গেছে
মেঘ।
কোনার্ক-রথের চাকা
বিংশ শতাব্দীর সীমা অতিক্রম করে চলে যায়
আরো দূর শতাব্দীর কাছে।
তুমি খুব ভালোবেসেছিলে
তুমি খুব কাছে এসেছিলে।
এখন তোমারও সৌধ ভেদ করে
চলে যেতে হবে
আরো বড় বেদনার
আরো বড় আগুনের আরতির দিকে।
সেই কবে থেকে জ্বলছি
জ্ব’লে জ্ব’লে নিভে গেছি ব’লে
তুমি দেখতে পাও নি ।
সেই কবে থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছি
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাতিস্তম্ভের মতো ভেঙে পড়েছি ব’লে
তুমি লক্ষ্য করো নি ।
সেই কবে থেকে ডাকছি
ডাকতে ডাকতে স্বরতন্ত্রি ছিঁড়ে বোবা হয়ে গেছি ব’লে
তুমি শুনতে পাও নি ‘।
সেই কবে থেকে ফুটে আছি
ফুটে ফুটে শাখা থেকে ঝ’রে গেছি ব’লে
তুমি কখনো তোলো নি ।
সেই কবে থেকে তাকিয়ে রয়েছি
তাকিয়ে তাকিয়ে অন্ধ হয়ে গেছি ব’লে
একবারো তোমাকে দেখি নি ।
তোমার দিকে তাকাই আমি দেখি অতল চোখ,
দেখি তোমার শরীর আর বুঝি তোমার মন,
এখনো খুঁজে পাইনি তার আকাঙ্ক্ষার লোক,
করুণ এক প্রতীক্ষায় শরীর ইন্ধন।
স্মরণে আসে অনেক কাল পড়েছি বিজ্ঞান,
গণিত দিয়ে বেঁধেছে নর বিপুল বিশ্বের
সকল কিছু, অথচ আজও অধরা তার প্রাণ,
অবুঝ তার শরীরে কাঁদে অজ্ঞতার জের!
শোণিত যদি ডুয়েট গায় হয় না তবে মিল।
বিশ্বজুড়ে কাটছে শুনি অজ্ঞতার তান,
অথচ পরিসংখ্যানের ঊর্ধ্বে সাবলীল
দ্বৈত কোনো সঙ্গীতের পাইনি সন্ধান।
তোমার দিকে তাকাই আমি কি যে রহস্যের
অতল এক সমুদ্রের গভীর উদ্ভাস
তোমার চোখে, শরীরে, মনে, অজ্ঞতার জের
হয়তো দেবে ব্যর্থ ক'রে সমুদ্রের শ্বাস।
৪.৭.১৯৫৭
ওই যে গোলাপ দুলছে, ও কি
ফুল না আগুন, ঠিক বুঝি না।
এগিয়ে গিয়ে পিছিয়ে আসি,
ভাবতে থাকি ধরব কি না।
ভাবতে থাকি, ঠিক কতবার
ফুলের বনে ভুল দেখেছি।
ভরদুপুরে গোলাপ ভেবে
অগ্নিশিখায় হাত রেখেছি।
গোলাপ, তুমি গোলাপ তো ঠিক?
হও যদি সেই আগুন, তবে
এই অবেলায় ফুলের খেলায়
ফের যে আমায় পুড়তে হবে।
তোমার চোখজোড়া পাঠ-অভ্যাসের মতো
পড়ে আছে আমার পড়ার টেবিলে
আমি তোমার চোখের মুখবন্ধ খুলি,
খুঁজি কাঁচল পংক্তি ভূমিকার একাগ্র শিকড় প্রণয়,
তোমার চোখ জোড়া সমুদ্র অ্যাকুরিয়াম
যেন দূর কৃষ্নবিন্দুর মাছ
ফেনায়িত সাদা ক্যানভাসের মুখ
পড়ে আছে আমার ঋজুময় ইজেলে ।
আমি তোমার চোখের রং মুখস্থ করি
তোমার চোখ জোড়া পাহাড়ের ঢালু পথ,
সমতলে গড়ে ওঠা কুঁড়েঘর, ছাতা ।
ঝর্ণার ঠোঁটে বসে থাকা শুভ্র পাথর প্রেমিক ।
আমি তোমার চোখের মুগ্ধতা মুখস্থ করি ।
তোমার চোখজোড়া লুক্কায়িত ঝিনুক-শঙ্খ
বুকে তার কান্নার গভীর সমুদ্র,
আমি তোমার চোখের শব্দ মুখস্থ করি ।
তোমার চোখ জোড়া ভোরের স্নিগ্ধ নিরবতা,
নারকেল পাতার ভুরুভঙ্গিমার বিন্দু বিন্দু শিশিরের স্বেদ ।
আমি তোমার চোখের মগ্নতা মুখস্থ করি ।
তোমার চোখজোড়া দুপারের দুটো রঙধনু, সেতু,
এপারে অপেক্ষমান মানুষের নিঃশব্দ হাঁক,
ওপারে বিশ্বাস চুমু খায় দুপারের প্রেমময় ভূমি ।
আমি তোমার চোখের সীমানা মুখস্থ করি ।
এখন নয়। অন্য একদিন
তোমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তেই
জন্ম নেবে একটি নীলশিশু
রুদ্র? নাকি, ঈশান তার নাম
তোমার বুকে কঠিন জন্মায়
তোমার বুকে কঠিন বড়ো হয়
তোমার বুকে শিশুর মতো সে
গভীর নীল নগ্ন বনচারী
যৌবনে তার ধূসর হবে দেহ
ছড়িয়ে দিও ভস্ম তার প'রে
কপালজুড়ে আগুন দিয়ো তাকে
আগুন, যেন পার্বতীর আদর
এখন নয়। নতুন কোনোদিন
বিষাণ এখন সহজে বাজবে না
এখন রাত সহজ আঁধার নয়
শ্মশান তবু স্বপ্নে ভরে যাক
সংকোচে জানাই আজ: একবার মুগ্ধ হতে চাই।
তাকিয়েছি দূর থেকে। এতদিন প্রকাশ্যে বলিনি।
এতদিন সাহস ছিল না কোনো ঝর্ণাজলে লুণ্ঠিত হবার –
আজ দেখি অবগাহনের কাল পেরিয়ে চলেছি দিনে দিনে-
জানি, পুরুষের কাছে দস্যুতাই প্রত্যাশা করেছো।
তোমাকে ফুলের দেশে নিয়ে যাবে ব’লে যে-প্রেমিক
ফেলে রেখে গেছে পথে, জানি, তার মিথ্যে বাগদান
হাড়ের মালার মতো এখনো জড়িয়ে রাখো চুলে।
আজ যদি বলি, সেই মালার কঙ্কালগ্রন্থি আমি
ছিন্ন করবার জন্য অধিকার চাইতে এসেছি? যদি বলি
আমি সে-পুরুষ, দ্যাখো, যার জন্য তুমি এতকাল
অক্ষত রেখেছো ওই রোমাঞ্চিত যমুনা তোমার?
শোনো, আমি রাত্রিচর। আমি এই সভ্যতার কাছে
এখনো গোপন ক’রে রেখেছি আমার দগ্ধ ডানা;
সমস্ত যৌবন ধ’রে ব্যধিঘোর কাটেনি আমার। আমি একা
দেখেছি ফুলের জন্ম মৃতের শয্যার পাশে বসে,
জন্মান্ধ মেয়েকে আমি জ্যোস্নার ধারণা দেব ব’লে
এখনো রাত্রির এই মরুভুমি জাগিয়ে রেখেছি।
দ্যাখো, সেই মরুরাত্রি চোখ থেকে চোখে আজ পাঠালো সংকেত –
যদি বুঝে থাকো তবে একবার মুগ্ধ করো বধির কবিকে;
সে যদি সংকোচ করে, তবে লোকসমক্ষে দাঁড়িয়ে
তাকে অন্ধ করো, তার দগ্ধ চোখে ঢেলে দাও অসমাপ্ত চুম্বন তোমার…
পৃথিবী দেখুক, এই তীব্র সূর্যের সামনে তুমি
সভ্য পথচারীদের আগুনে স্তম্ভিত ক’রে রেখে
উন্মাদ কবির সঙ্গে স্নান করছো প্রকাশ্য ঝর্ণায়।
একটা কথায় ফুলকি উড়ে শুকনো ঘাসে পড়বে কবে
সারা শহর উথাল পাথাল, ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে
কাটবে চিবুক, চিড় খাবে বুক
লাগাম কেড়ে ছুটবে নাটক
শুকনো কুয়োয় ঝাঁপ দেবে সুখ
জেলখানাতে স্বপ্ন আটক
একটা ব্যথা বর্শা হয়ে মৌচাকেতে বিঁধবে কবে
সারা শহর রক্ত লহর, আশ মিটিয়ে যুদ্ধ হবে
ছিড়বে মুখোশ আগ্নেয় রোষ
জ্বলবে আগুন পুতুল নাচে
ভাঙবে গরাদ তীব্র সাহস
অনেক ছবি টুকরো কাচে
একটা কুঁড়ি বারুদগন্ধে মাতাল করে ফুটবে কবে
সারা শহর উথাল পাথাল, ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে।
ফোটে পলাশ থোকা থোকা, সে যে কীসের বহিঃপ্রকাশ
যেন রাগ করে খামোকা তুমি মুখ ফিরিয়েছ
নাম সর্বনাশের আঁধার, জোটে বেয়াক্কেলে রাধা
আমি মধুসূদন দাদার সঙ্গে বদল করি চোখ
দেখি জীবন কত ছোট, নেশা জড়ায় ওতপ্রোত
ভাসাই রোমানভের বোতল... আগুন ঠান্ডা করুক পেট
যদি বসন্তে না বাঁচি, তবে কীসের জন্যে আছি
পেরোয় আকাশ ছোঁয়া পাচিল আমার উড়ন্ত কার্পেট
আমি রাত কলেজে পড়ি, তুমি বিলাসখানি তোড়ি
মাঝে হাজার ঘুমের বড়ি... আমার ঘুম আসেনা তাও
চুমু বিষের চেয়েও তেতো... সবই সামলে নেওয়া যেত
যদি আমার মাথার ভেতর তোমার চোখ দুটো নামাও।
দ্যাখো কেমন কানায় কানায় ভাসছে নীল কচুরিপানা
শুধু তোমার হাতেই মানায় আমার নতুন লেখা বই
তুমি কাব্যে পেরোও শতক, আমি ক্লান্ত অনুঘটক
চির জ্যামের মধ্যে অটো তুমি দিগন্তে লাগসই
দুটো বাতিল ট্রেনের মত চল কারশেডে ঘুমোই
শুধু হাসি-মশকরা দিয়ে তো আর দিন চলেনা
অভিমান আসে, অভাব এসে খেলা দেখায়।
মনখারাপ তো কাঠবেড়ালি, আসে আর যায়।
রাগ চোখ পাকায়
ছুটে আসে অপমান, জ্বালা ধরিয়ে দেয় গায়ে।
আমি উন্মুখ হয়ে থাকি ভালবাসার জন্যে-
নিঃশ্বব্দে ভালবাসা এসে পাশে বসে
মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়
জানি চলে যাবে তবু বলি, যেওনা ছুঁয়ে থাকো
বলি, সামান্য লোহাকে সোনা করে দাও
ভালোবাসাই শুধু পারে অন্ধকে হাত ধরে রাস্তা পার করে দিতে।
শুধু তুমি সুস্থ হবে।
আমি দিয়ে দেবাে আমার কোজাগরীর চাঁদ,
শাদা দেয়ালের ময়ূরকণ্ঠী আলো,
দিয়ে দেবাে বিগত বছরের মরা পাখির মমতা,
আর আগামী বছরের কলাগাছটির স্বপ্ন।
চ'লে যেতে যেতে সবাই তাে তাই ব'লে গেলাে।
কুন্তী নদীর গেরুয়া জল তার সবুজ ছায়া-কাঁপা ঠাণ্ডা গলায়
আমাকে বলেছে,
শুকনাে সােনালি গােরুর গাড়িগুলো
ক্লান্ত কাদাটে গলায় আমাকে বলেছে,
শেষ হেমন্তের বুড়ো সবুজ পাতারা
আসন্ন মৃত্যুর খস্ খসে গলাতে বলেছে
তুমি সুস্থ হলেই ওরা আবার ফিরবে ।
এমন কি
তুলসীতলার যে-প্রদীপটি ধ'রে
তুমি আমার মুখ দেখেছাে, তাকেও ভাসিয়ে দিয়ে,
একটি শুভ্র স্তব হ'য়ে জ্বলবো তােমার শিয়রে
আসুক, ওরা ফিরে আসুক, যারা চিরকাল
শুধুই চ'লে যাচ্ছে, এখান থেকে অন্যখানে
উৎপাটিত একগুচ্ছ কচি সবুজ দূর্বার মতাে
তুচ্ছ, উষ্ণ, কাতর
আমি তােমার যন্ত্রণা মুছে নেবো :
তার বদলে, ঈশ্বর, তার বদলে আসুক
তােমার কাঙ্ক্ষিত আরােগ্য।