যখনই তোমার কাছে আসি হাসতে হাসতে গড়িয়ে দিই নিজেকে
মজার মজার কথা বলি আর খুব সন্তর্পণে থাকি আর
নিজেকে উজাড় করে দিতে দিতে লুকিয়ে রাখি
চিকচিকে চোখের কোণ, অন্ধ শ্রাবণ আর ব্যক্তিগত পাগলঝোরা।
Sunday 26 July 2020
সকাল- অরণি বসু
ছুরির ফলা থেকে যেন নেমে এসেছে এইমাত্র
এত দীপ্র, দুহাত ছড়ানো তোমার হাসি
আমাকে এক অচেনা সমুদ্রসৈকতে এনে ফেলে।
শরীর পুড়িয়ে দেওয়া তাপ,
মন পুড়িয়ে দেওয়া খবর
সব তুচ্ছ মনে হয়।
মনে হয়, আরেকবার বেজে উঠি,
আরেকবার ছুঁয়ে যাক সেতারের অলীক মূর্ছনা।
অনেক মনখারাপের অলিগলি পেরিয়ে
একটা সকাল আজ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল
তোমার চওড়া হাসিতে।
আর যদি নাই আসো- বিনয় মজুমদার
আর যদি নাই আসো,ফুটন্ত জলের নভোচারী
বাষ্পের সহিত যদি বাতাসের মতো না-ই মেশো,
সেও এক অভিজ্ঞতা ; অগণন কুসুমের দেশে
নীল বা নীলাভবর্ণ গোলাপের অভাবের মতো
তোমার অভাব বুঝি ; কে জানে হয়তো অবশেষে
বিগলিত হতে পারো ; আশ্চর্য দর্শনবহু আছে
নিজের চুলের মৃদু ঘ্রাণের মতন তোমাকেও
হয়তো পাইনা আমি, পূর্ণিমার তিথিতেও দেখি
অস্ফুট লজ্জায় ম্লান ক্ষীণ চন্দ্রকলা উঠে থাকে,
গ্রহণ হবার ফলে, এরূপ দর্শন বহু আছে ।
১৯৮৪- ভাস্কর চক্রবর্তী
ঝাউ এসে মমতার মতো
বারান্দা ছুঁয়েছে।
তোমার শান্ত মুখ
বিকেলের নিরব গভীরে।
আমি এই
নিঝ্ঝুম হৃদয়
তোমার মুখের পাশে রাখি।
মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস- মহাদেব সাহা
কেউ জানে না একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেড়ায়-
কোনো বিষণ্ন ক্যাসেটেও এতো বেদনার সংগ্রহ নেই আর,
এই বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস যেন একখানি
অন্তহীন প্রগাঢ় এপিক!
পাতায় পাতায় চোখের জল সেখানে লিপিবদ্ধ
আর মনোবেদনা সেই এপিকের ট্রাজিক মলাট;
মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস, এতো দীর্ঘশ্বাস,
কে জানতো!
দীর্ঘশ্বাসভরা এই বুকের চেয়ে শীতপ্রধান বিপন্ন অঞ্চল
আর কোথাও নেই, এমন হলুদ, ধূসর ও তুষারাবৃত!
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে
বেড়ায়, কেউ জানে না
হঠাৎ একসঙ্গে অসংখ্য দুঃখ যদি কখনো কেঁদে ওঠে
কিংবা যদি প্রাচীন শিলালিপি থেকে সব শোকের গান সশব্দে বেজে যায়,
তাহলে যেমন মধ্যাহ্নের আকাশ সহসা দুঃখে ম্লান হয়ে যাবে গোলাপ হবে কৃষ্ণবর্ণ, তার চেয়েও বিষণ্নতা নেমে আসবেমমানুষের বুক থেকে এই দীর্ঘশ্বাস যদি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে।
তেমন সম্ভাবনা আছে বলেই মানুষ বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখে
তার চোখে নিয়তই জল ঝরে তবু দেখা যায় না;
মানুষের বুকের ভেতর কতো যে দীর্ঘশ্বাস,
জমাট বেঁধে আছে
কতো যে ক্রন্দন, পাতা ঝরার শব্দ, মৃত্যুসংবাদ
মানুষের বুকের মধ্যে ব্যথিত ব্যাকুল ইতিহাস
আর আহত সভ্যতা মেঘের মতো ঘনীভূত হতে হতে একেকটি মর্মান্তিক দীর্ঘশ্বাস হয়ে আছে
মানুষ তাকে বয়ে বয়ে দগ্ধ বেঁচে থাকে;
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে
বেড়ায়, কেউ জানে না
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে
বেড়ায়, কেউ জানে না একেকটি মানুষ নিজের মধ্যে কীভাবে নিজেই মরে যায়,
হায়, কেউ জানে না!
Saturday 25 July 2020
সীমান্ত- স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
কেউ নেই আজ বৃষ্টি রয়েছে শুধু
এলোমেলো কিছু গাছেদের বৈশাখী
জল পেয়ে মাটি ঘুমিয়ে পড়েছে কবে
আমি সারারাত একা একা জেগে থাকি
মেঘের ওপারে ছড়িয়ে রয়েছে তারা
চাঁদ লেগে সব হলুদ হয়েছে দূরে
আজ সন্ধেয় বৃষ্টির ফোঁটা দিয়ে
তোমার যাওয়ার পথটুকু রাখি মুড়ে
বুকের ভেতরে শহর ফুরিয়ে এল
তুমি চলে গেলে কী জানি কীসের দোষে
জামার কোনায় মনমরা দাগ লাগে
তবু আজও কেউ কালবৈশাখী পোষে
আমিও পুষছি পুরনো তোমার ছায়া
পেরিয়ে যাচ্ছি ঋতুদের হাতছানি
কাঁটাতার হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি একা...
আমাদের আর কোনো দেশ নেই, জানি
বৃষ্টি- শঙ্খ ঘোষ
আমার দুঃখের দিন তথাগত
আমার সুখের দিন ভাসমান!
এমন বৃষ্টির দিন পথে-পথে
আমার মৃত্যুর দিন মনে পড়ে।
আবার সুখের মাঠ জলভরা
আবার দুঃখের ধান ভরে যায়!
এমন বৃষ্টির দিন মনে পড়ে
আমার জন্মের কোনো শেষ নেই।
অপচয়-শঙ্খ ঘোষ
এই রাত্রি নিঃস্ব। খোলা আকাশকে মুখোমুখি রেখে
শূন্যতার মাঝখানে অবলম্বনহীন ভেসে আছি।
অনন্তশয়ানছবি, দূরে দূরে বুদবুদের মতো
তারাগুলি ধরে আছে সাবেকযুগের কাতরতা।
বিশ্বাস? কোথায় তার বাসা ছিল ভেবেছ কখনো?
আঘাত কোথায়? সে কি ডমরুর মতো বেজে ওঠে?
তোমার মুখের ডৌল মাঝো মাঝে তবু মনে পড়ে
কালরাত্রে, প্রবাহণে, আগুনে না অবিমৃশ্য ঝড়ে---
তুৃৃমিহীন তুমি দিয়ে ভরে রাখি যা ভরার নয়
আজ শুধু মনে পড়ে আমার সমস্ত অপচয়।
সহজ- শঙ্খ ঘোষ
আমিই সবার চেয়ে কম বুঝি, তাই
আচম্বিতে আমার বাঁ-পাশে এসে হেসে
পিঠ ছুঁয়ে চলে যাও;
'অত কি সহজ?' বল তুমি।
তার পর আমার কী বাকি থাকে? অপরাধ
আমার দু-পাশে কেন কাশফুল হয়ে ভরে ওঠে?
শরীরে শারদবেলা নত হয়ে নেমে আসে যেন-বা আমিই শস্যভূমি-
অত যে সহজ নয় মাঝে-মাঝে তাও ভুলে যাই।
নিছক স্বপ্নে স্বপ্নে- সমীরণ ঘোষ
ঠিক এইখান থেকে শুরু করি খেলা
স্মৃতি থেকে উড়ে আসছে যে ঘাস
স্মৃতি থেকে ঝরে পড়ছে যে বরফ
আ-বুক শীতের মধ্যে দাঁড়িয়ে
তুমি চিনিয়ে দিলে কালোবিন্দুর স্বর্গহীনতা আমাদের
আমি শাদা চাদরের লম্বা ঝকঝকে ভোর
হাওয়া দিচ্ছে, মোচাফুলের মতো নড়ে উঠছে বিশ্বাস
মানুষের হাত এসে অবিরাম মানুষের সুড়ঙ্গ থেকে
ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকার...
তোমার রক্ত থেকে যে-বরফ গলে নামছে আজ
তোমার তৃষ্ণা থেকে যে-বিষ ধুয়ে যাচ্ছে দক্ষিণে
আমি প্রিয়দের দেখাবো সেইসব---
ঘুড়ির দিন, ফাঁপা চিৎকার, আলো, আর বিষের গান
তুমি কমলালেবুর পাহাড় নিয়ে দাঁড়িয়ে দূরে
কোনো এক নদীর হৃদয় বরাবর
উড়ে যাচ্ছে লাল স্কার্ফ, ধানখেতের পাশ দিয়ে
স্কুলবাসভর্তি যে বসন্তের দিন
তাদের একে একে নামিয়ে নিচ্ছো
আপেলের মতো লাল, মাংসল, স্কুলের ভেতর
মায়া- শঙ্খ ঘোষ
নিঃসঙ্গ পাথরের গায়ে গড়িয়ে নামছে ক্ষীণ জলরেখা
তার অবলীলাক্রম দেখতে দেখতে মনে পড়ে
এ-রকমই হবার কথা ছিল
শূন্যে পাক খেতে খেতে ঝরে পড়ছে অনাথপাতা
তার উদাসীনতা দেখতে দেখতে মনে পড়ে
এ-রকমই হবার কথা ছিল
ঘাসের ওপর দিয়ে খরগোসের হালকা দৌড়
তার মসৃণতা দেখতে দেখতে মনে পড়ে
এ-রকমই হবার কথা ছিল
মাটি তার বুক পেতে সবই নেবে বলে স্থির হয়ে আছে
ভাঙা পাঁচিলের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বিকেলে
সমস্তই দেখি
অথচ তোমার জন্য মায়া আজও জটিলতাময়।
মীরাদি- বিজয়া মুখোপাধ্যায়
মীরাদি,
তুমি যদি সুন্দরী নও তো সে কে।
খাতা দেখছ বসে
শেষ বিকেলের রোদ দেয়ালে ছড়ানো
তোমার গালে গ্রিলের ছায়া পড়েছে
ইচ্ছে করছে
আমার হৃদয় বেটে মিশিয়ে দিই
ওই গালে
কপালে চিবুকে।
মীরাদি, তোমার
যেটুকু প্রকাশ্যে দেখি -
বিষাদের চন্দনে নিলীন,
আমাকে একান্তে বলো
অন্তরালে আরও কি সুগন্ধ আছে।
কার জন্য ব্রতবদ্ধ তুমি এতকাল
সে কি অন্ধ পাষাণপ্রতিমা,
বলো তার নামপরিচয়
পাথর ঝরাব আমি।
কিন্তু তারপর
তোমার চন্দন যদি ফুরোয় মীরাদি -
ফুরোবেই,
তখন আমার দিন কাটবে কী করে।
আজ- স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
সারাদিন আজ বৃষ্টি আসুক পাখি
ভেজা গাছেদের ডানায় বসুক ঘুম
আমিও নাহয় তোমার দু চোখে রাখি
মেঘ জমা কোনও পাহাড়ের মরসুম
তুমিও কোথাও আলো ছায়া বেঁচে থাকো
মেঘ পিঠে নিয়ে আমিও বেরই ট্রাম
বড় গাছেদের গোপনে পালক রাখো
শহরে ওড়াও নরম গোলাপি খাম
সাদা কাগজের মনমরা আলো ভাসে
বুকের শহর বহুদিন ভাঙাচোরা
প্যাস্টেল রঙে কারা যেন ফিরে আসে...
বিগত জন্মে ছেড়ে গিয়েছিল ওরা!
তুমিও আমায় ছেড়ে গেলে বৈশাখে
এখন শ্রাবণ নির্জন পথে ঋণ
গলাচেরা পাখি কাকে যে এমন ডাকে
আজকে তোমার একলা থাকার দিন