আগুনে পোড়াব তোর স্মৃতি , জলে ভাসাবো না ,
আগুনে সমস্ত খায় ,
স্মৃতি খায় , সর্বস্বতা খায় , জৈব চুম্বকের মতো
যেই শরীরের কাতরতা , তা -ও খায়
আগুন সমস্ত খেয়ে ছাই ফেলে রাখে !
ছাইয়ের নিজস্ব কোনো অবয়ব নেই
উদলা হওয়ায় হু হু ছাই উড়ে যায়
হৃদয় শ্মশান হোক ! সব স্মৃতি পুড়ে যাক তোর
শ্মশান হৃদয় নিয়ে একা জেগে থাকি ,
নদী তীরে নিরালায় পবিত্র একাকী !
জলে ভাসাবো না তোর স্মৃতি
জলের অপর নাম জীবন ,জেনেছি !
জলের সারল্যে ফের জেগে উঠতে পারে
তোর স্বয়ংভরা স্মৃতি
তাই জলে ভাসাবো না ,---
আগুনে পোড়াবো তোর স্মৃতি !
Sunday 6 September 2020
পাখি- বিজয়া মুখোপাধ্যায়
যে পাখি বুকের ভেতরে থাকে, তার
কোনও-না-কোনও ডানায় কেন বারবার
আঘাত লাগাও? তাকে শুশ্রূষা করোনি কখনও
মন দিয়ে?
আজ তার আহত ডানায় বুলিয়ে দাও হাত
সাফ করে দাও ওর ধুলোবালি, সংক্রমণ
কাছে থাকো, ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখো ওর বুকের ধুকপুক।
ধীরে ধীরে সুস্থ করে তোলো ওকে
তার পর ছেড়ে দাও আকাশে
না-ফেরার স্বাধীনতা দাও
সালিম আলি অন্ধকার থেকে তোমাকে স্নেহ জানাবেন।
তার পর
অর্ধজন্ম তুমি কাটিয়ে দাও পাখিহীন
কষ্ট নাও বুকে
তোমার নতুন জন্ম হোক।
পাতা ঝরে গেলে- কালীকৃষ্ণ গুহ
পাতা ঝরে গেলে
তবু তুমি ছায়ার ভিতর দাঁড়িয়ে থাকো
রুগ্ন পবিত্রতা।
পাতা ঝরে গেলে
বুকের ভিতর কান্না তুমি গোপন করে রাখো
ছিন্ন করো কথা?
পাতা ঝরে গেলে
কুয়াশা তোমার জীবনের নীচে নেমে যায়, তবু ঢাকো
মুখ। সে কি সবই পাতার বিষণ্ণতা?
৫.৭.৬৬
Monday 31 August 2020
আমি তোমায় গোলাপ দেব-মাইনুল এইচ সিরাজী
টবটা রাঙিয়েছি সবুজ রঙে। সবুজ টবে কী ফুল ফোটাব? কেন, লাল? তাহলে গোলাপই হোক। গোলাপ ছাড়া কোন ফুলে আর মানাবে তোমায়? লাল ছাড়া কোন রঙে আর রাঙাব তোমায়? সুতরাং তোমার জন্য গোলাপ। সবুজ টবে লাগিয়েছি। আমার জানালার পাশের বারান্দায়। প্রতি সকালে টবটা আমি সরিয়ে দিই আলোর দিকে। প্রতি বিকেলে জল ঢালি আমি গোলাপ চারায়। আর সারা দিনমান, দুপুর কিংবা সন্ধ্যাগুলোয় অথবা রাতবিরাতে আমার বুকের গভীরে গজিয়ে ওঠা আরেকটি গোলাপের গাছের যত্ন নিই আমি। অতি আদরে। ভালোবাসায়। গোলাপের কাঁটায় আমার হৃৎপিণ্ডে রক্তক্ষরণ হয়। ডালপালা ছড়িয়ে যায় আমার সারাটা অস্তিত্বে। এই আমি হয়ে যেতে থাকি আস্ত একটা গোলাপগাছ। তোমার জন্য। আমার সবুজ টবের গাছটাও বাড়তে থাকে। ডালপালা ছড়ায়। চলে ফুল ফোটানোর আয়োজন। তোমার জন্য।আমার অপেক্ষার প্রহরগুলো ছড়িয়ে পড়ে জলে-হাওয়ায়, কখনো বা ডালপালা আর পাতায় পাতায়। তোমার সাড়া পাওয়ার অপেক্ষা অথবা অপেক্ষা গোলাপ ফোটার। কিংবা দুটোরই।তুমি আসবে বলেছিলে। না, বলোনি। তোমার ভেজা চোখে, নোয়ানো পাপড়িতে, তোমার কম্পমান ঠোঁটে প্রশ্রয়ের মায়া দেখেছিলাম আমি। তাই তো বুনেছি সবুজ টবে গোলাপের চারা।আসবে তুমি। কোনো মিথ্যে নেই। সবুজ শাড়িতে গোলাপি মুখাবয়ব ফুটে উঠবে তোমার। তোমাকে নিয়ে যাব বারান্দায়। হাত ধরে। যেখানে আমার গোলাপ অপেক্ষায় আছে। ফোটার জন্য। তোমার জন্য। তোমাকে নিয়ে রাখব বুকের মাঝে। যেখানে রক্তক্ষরণ হচ্ছে বহুদিন। তোমাকে দেখার পর থেকে। চুড়িতে-নূপুরে টুংটাং শব্দ তুলে আসবে তুমি। সেই শব্দে পাপড়ি মেলবে আমার গোলাপ। সেই শব্দে বন্ধ হবে বুকের রক্তপাত। ...অতঃপর আমার প্রতীক্ষা নীল হয়ে ছড়িয়ে যায় আকাশে আকাশে। ভালোবাসাও। আমার গোলাপটা ঝরে যায়। বিবর্ণ হয়ে যায় টবের সবুজ। রক্ত ঝরে ঝরে অনুভূতিশূন্য হয়ে যায় বুকটা। না-ই বা যদি আসবে, কেন তবে ঠোঁট কাঁপালে? পাপড়ি নোয়ালে? না-ই বা যদি আসবে, কেন তবে চোখ ভেজালে?
প্রকাশ: ৭ এপ্রিল ২০১৩ (প্রথম আলো- বন্ধুসভা)
https://www.bondhushava.com/আমি-তোমায়-গোলাপ-দেব
Saturday 29 August 2020
রূপান্তর- শামসুর রাহমান
চঞ্চলা নর্তকী নও, অথচ যখন হাঁটো কিংবা ছুটে যাও,
বর্ষার বৃষ্টি পরে রামধনু উঠলে আকাশে,
বারান্দায়, চলায় সহজে লাগে ছন্দের বিদ্যুৎ।
যখন আয়নার সামনে লিপস্টিক মাখো ঠোঁটে, হাই-হিল জুতো
পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামো, হাতে বই, বুকের উপর
কালো বেণী, চিবুকে ঘামের ফোটা, কী-যে ভালো লাগে।
যখন বাগানে যাও, ফুল তোলো, ঝকঝকে দাঁতে
হঠাৎ কামড়ে ধরো সবুজ পেয়ারা, ময়নাকে
ছাতু দাও খেতে আর ভাঁড়ারের অন্ধকার কোণে
আঁতকে ওঠো আরশোলা দেখে, পানি চেয়ে
ভেঙে ফ্যালো গ্লাস, নখ খাও এবং চাবির রিং
ঘোরাও আঙুলে
অথবা সুরের তাল কেটে গেলে তন্ময় বিকেলে
খিলখিল ওঠো হেসে, ক্যারম খেলতে গিয়ে সারা
খেলাটাই করো মাটি
কী ক’রে বোঝাই কত ভালো লাগে তোমাকে তখন।
অবশ্য কখনো কবিতা পড়ো না তুমি (ক্লাসের বরাদ্দ পদ্য ছাড়া)
তাতে কী? তবুও এ সুন্দর শরীরী সৌরভে মেতে
চেনা পৃথিবীতে আছো তাই মেটাই চোখের তৃষ্ণা সারাক্ষণ।
হয়ত পারতে হ’তে সোনালি-নিবিড় বালুকণা।
আমার মুঠোয় ঝলোমলো, ভাবি তুমি অর্গানের
ধ্বনির মতোই শ্রাবণের কালো ফোটা পাতাবাহারের বুকে,
বাগানের টসটসে ফলের সুরভি, মাংসে-বেঁধা
গোলাপের কাঁটা পারতে হ’তে...
প্রতীক্ষা- শামসুর রাহমান
এতদিনে জেনে গেছি, সে তোমার পরিহাস ছিল
পুরোপুরি, হয়তো কোনো দিন
দেখা হবে,-কতবার ভেবেছি আবেগভরে আর
তোমার আসার পথে দিয়েছি বিছিয়ে স্বপ্নময়
বাসনার রক্তিম গালিচা।
কিন্তু অলিখিত কবিতার মতো তুমি থেকে গেছ
অদ্যাবধি চেতনায়। সে কোন রহস্যময় প্রাণী
পরম সোহাগে করে পান সারাবেলা
আমার আপন
হৃদয়ের জল, কোনো কোনো দিন কিছুবা শোণিত!
এখন তোমাকে দেখি (মনে হয় দেখি) পথে পথে,
গাছের ছায়ায় পার্কে, স্মৃতির মতন গোধূলির ছোপ-লাগা
বারান্দায়, বাস টার্মিনালে,
প্রত্যেক নারীর মধ্যে তোমাকেই দেখি, মানে খুঁজি
ইতস্তত বারবার। এখনো তোমার রূপ নিতান্ত অচেনা
আমার নিকট?
অস্পষ্ট ধারণা তুমি এক? স্বপ্নকুয়াশায় ঢাকা?
যখন তোমার মুখে চিবুকে গ্রীবায় স্তনমূলে
নামে জলধারা,
তখন তোমাকে কী রকম মনে হয়,
পারব না বলতে কখনো;
যখন তোমার পিঠে শ্যাম্পু করা চুল একরাশ
গীতিকবিতার মতো শুয়ে থাকে কোমল-উজ্জ্বল,
তখন তোমার মুখে কতটুকু তুমিত্ব বিরাজে,
জানি না, অথবা
কারো অভিযানপ্রিয় হাত তোমার স্তনের দিকে
অগ্রসর হ’লে তুমি কেমন বিহ্বল হ’য়ে যাও,
এবং তোমার ওষ্ঠে কেউ চুমু খেলে
তোমার চোখের পাতা অতি দ্রুত নেমে আসে কিনা-
আমি তা’ জানি না।
এখন তোমাকে খুঁজে বেড়ানোর অসুখ নিয়ত
ভোগাচ্ছে আমাকে।
যে কানো নারীর মুখ হঠাৎ দেখলে
ধুক ধক ক’রে ওঠে-সে কি তুমি? হৃৎস্পন্দন, ওষ্ঠ, বাহু-
চোখ হয়ে যায় সবই একটি নিমেষে। সে কি তুমি?
কোনোখানে তোমাকে না দেখে বারংবার
কেবলি আমার মন ভীষণ খারাপ হ’য়ে যায়।
তবে কি স্বপ্নের ঘোরে আজীবন জ্বলন্ত রাত্তিরে
তোমার উদ্দেশে আমি বিষণ্ণ কবিতা লিখে যাব?
এক্ষুণি আমাকে এসে ব’লে দাও সাফ-
তুমি আর প্রতীক্ষায় থেকো না নির্বোধ।
কী পরীক্ষা নেবে?- শামসুর রাহমান
কী পরীক্ষা নেবে তুমি আর বারবার?
হাতে জপমালা নেই, তবু
আমি তো তোমার নাম মন্ত্রের মতন
করি উচ্চারণ সর্বক্ষণ। যেখানে তোমার ছায়া
স্বপ্নিল বিলাসে
অপূর্ব লুটিয়ে পড়ে, সেখানে আমার ওষ্ঠ রেখে
অনেক আলোকবর্ষ যাপন করতে পারি, তোমারই উদ্দেশে
সাঁতার না জেনেও নিঃশঙ্ক দ্বিধাহীন
গহন নদীতে নেমে যেতে পারি।
তোমার সন্ধানে ক্রোশ দাউ দাউ পথ হেঁটে
অগ্নিশুদ্ধ হতে পারি, পারি
বুকের শোণিতে ফুল ফোটাতে পাষাণে।
যখন পাথরে হাত রাখি,
পাথর থাকে না আর অরূপ পাথর,
হয়ে যায় প্রতিমা তোমার।
যখন বৃক্ষের দিকে দৃষ্টি মেলে দিই,
বৃক্ষ হয় তোমার শরীর।
প্রত্যহ তোমার প্রতীক্ষায় এক বুক উপদ্রব নিয়ে থাকি,
ব্যাকুলতা বারবার সিঁদ কেটে ঢোকে,
হৃদয়ের ঘরগেরস্থালি, বনস্থলী
লুট হয়ে যায়
প্রত্যহ তোমার প্রতীক্ষায়, আমি তাই তুমি ছাড়া
কারুর জন্যেই
পারি না অপেক্ষা করতে আর।
ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়েছি তোমার ওষ্ঠজাম, তুমি না থাকলে
আমার সকল চুমো যাবে বনবাসে,
তোমার অমন হাত স্পর্শ ক’রে ছুঁয়েছি স্বর্গের
মল্লিকার, তুমি চ’লে গেলে
আমার ছোঁয়ার মতো অন্য কোনো হাত থাকবে না আর।
এরপর অনুরাগ নিক্তিতে মাপতে চাও, চাও
আমার পরীক্ষা নিতে নানা অছিলায়?
আর কি ভোগ চাও? নাকি একে নির্দ্বিধায়
সবি তো দিয়েছি।
হৃদয়ের আসবাবপত্তর সবি তো
স্বেচ্ছায় বিলিয়ে দিতে চাই, তবু কেন যাবতীয়
সম্পদ আমার
ক্রোক করবে বলে নিত্য আমাকে শাসাও?
আমি তো আমাকে সুখ দিতে চেয়ে কেবলি নিজের
অসুখ বাড়াই।
মাটি ছুঁয়ে বলছি এখন,
এই বৃক্ষমূলে আমি শীর্ণ হই, অন্ন আনি নিজে,
কান্নায় ধোয়াই পদযুগ।
কী পরীক্ষা নেবে তুমি আর বারবার?
আমার সম্মুখে তুলে ধরো বিষপাত্র,
নিষ্পলক দ্বিধাহীন নিমেষে উজাড় ক’রে দেবো।
আমার মৃত্যুর পরেও যদি- শামসুর রাহমান
একটি পাখী রোজ আমার জানালায়
আস্তে এসে বসে, তাকায় আশেপাশে।
কখনো দেয় শিস, বাড়ায় গলা তার;
আবার কখনোবা পাখাটা ঝাপটায়।
পালকে তার আঁকা কিসের ছবি যেন,
দু’চোখে আছে জমা মেঘের স্মৃতি কিছু;
নদীর স্বপ্নের জলজ কণাগুলি
এখনো তাঁর ঠোটে হয়তো গচ্ছিত।
কাউকে নীড়ে তার এসেছে ফেলে বুঝি?
হয়তো সেই নীড়, আকাশই আস্তানা।
তাই তো চোখ তার এমন গাঢ় নীল,
মেললে পাখা জাগে নীলের উৎসব।
যখন লিখি আমি টেবিলে ঝুঁকে আর
পড়তে বসি বই, তখন সেই পাখি
চকিতে দোল খায় আমার জানালায়-
খাতার পাতা জুড়ে ছড়িয়ে দেয় খুশি।
আমার মৃত্যুর পরেও যদি সেই
সুনীল পাখি আসে আমার জানালায়,
আবার শিস দেয়, আমার বইখাতা
যদি সে ঠোকরায়, দিও না বাধা তাকে।
দাগ- শামসুর রাহমান
'না, আমি কস্মিনকালে তোমার এ নৈঃসঙ্গ্য ঘোচাতে
পারবো না' ব'লে তুমি সেই ছোট ঘরটি গোছাতে
মন দিলে। এটা-সেটা নেড়েচেড়ে তুলে নিলে দুল
বালিসের নীচে থেকে, পরলে আবার। এলোচুল
সহজে বিন্যস্ত হলো; পরিচিত গন্ধমাখা ঘরে
বিধ্বস্ত স্নায়ুর রাজ্য, বন্দী আমি ভয়ের নিগড়ে।
বুঝি তাই অকস্মাৎ বুকে টেনে নিলাম তোমাকে
সংক্রামক হতাশায়। বললাম : 'হত্যা করো তাকে,--
আমার এ নৈঃসঙ্গ্যকে ; তোমার স্বপ্নের পাটাতনে
তুলে নাও হাত ধরে। বাকল-বঞ্চিত গাছ বনে
যেমন দাঁড়িয়ে থাকে তেমনি তুমি থাকো আজ পাশে,
আলিঙ্গনই জানি রক্ষাকবচ এমন সর্বনাশে।'
নৈঃসঙ্গ্য হত্যায় মেতে খুলে নিলে দুল, নিরুত্তাপ
বালিসে নামলো কালো উচ্ছল প্রপাত। কার ছাপ
খুঁজি তবু সবখানে? উন্মীলিত তোমার দু'চোখ
আমার চোখের নিচে, যেন দু'টি সভ্যতার শোক
ভ্রষ্টলগ্নে শুধু কাঁপে পাশাপাশি। দু'চোখের তটে
সে মুহূর্তে দেখি মহাপ্লাবনের দাগ জেগে ওঠে!
কেউ কি এখন- শামসুর রাহমান
কেউ কি এখন এই অবেলায়
আমার প্রতি বাড়িয়ে দেবে হাত?
আমার স্মৃতির ঝোপেঝাড়ে
হরিণ কাঁদে অন্ধকারে
এখন আমার বুকের ভেতর
শুকনো পাতা, বিষের মতো রাত।
দ্বিধান্বিত দাঁড়িয়ে আছি
একটি সাঁকোর কাছাকাছি
চোখ ফেরাতেই দেখি সাঁকো
এক নিমেষে ভাঙলো অকস্মাৎ।
গৃহে প্রবেশ করবো সুখে?
চৌকাঠে যায় কপাল ঠুকে।
বাইরে থাকি নতমুখে,
নেকড়েগুলো দেখায় তীক্ষ্ণ দাঁত।
অপরাহ্নে ভালোবাসা
চক্ষে নিয়ে গহন ভাষা
গান শোনালো সর্বনাশা
এই কি তবে মোহন অপঘাত?
কেউ কি এখন এই অবেলায়
আমার প্রতি বাড়িয়ে দেবে হাত?
এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়- শামসুর রাহমান
এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় ?
তেমন যোগ্য সমাধি কই ?
মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো
অথবা সুনীল-সাগর-জল-
সব কিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই !
তাইতো রাখি না এ লাশ আজ
মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে,
হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই।
তোর কাছ থেকে দূরে- শামসুর রাহমান
তোর কাছ থেকে দূরে , সে কোন্ নিশ্চিন্তিপুরে পালাতে চেয়েছি
প্রতিদিন , বুঝলি মতিন !
হয়তোবা টের পেয়ে অবশেষে নিজেই উধাও হয়ে গেলি
একটি নদীর তীরে মাঠ - ঘেঁষা , গাছ- ঘেরা, জুঁই কি চামেলি
ইত্যাদির ঘ্রাণময় বিজন নিবাসে। আমি তোকে
দীর্ঘ চৌদ্দ বছরের সাইকেডেলিক স্মরণের তীব্র ঝোঁকে
ডাকি মধ্যরাত্রির মতো বুক ছিঁড়ে বারংবার,
প্রতিধ্বনি , শুধু গূঢ় প্রতিধ্বনি ফিরে আসে মগজে আমার ।
কেমন আছিস তুই? এখনো কি ভীষণ অস্থির তুই, ওরে ?
এখনো কি অতি দ্রুত হেঁটে যাস দুঃস্বপ্নের ঘোরে
অলীক অলিন্দে কোনো ? অবাস্তব বন - বাদাড়ে ঘুরিস একা
ছিন্ন বেশ , নগ্নপদ সন্তের মতন? তোর দেখা ,
মানে তোর ঝলমলে প্রকৃত সত্তার দেখা পাবো কি আবার
কোনো দিন ? তোকে হারাবার
পর তুই অতিশয় বেগানা আমার বড়ো বেশি উদাসীন
হয়ে গেলি , রুপান্তরে আমার দুঃখের মতো , বুঝলি মতিন !
যখন এখানে ছিলি, বুকের নিকটে ছিলি, তোর হস্তদ্বয়
আমার স্বপ্নের ঝাড়লন্ঠন বেবাক অতিশয়
হিংস্রতায় বারংবার দিয়েছে দুলিয়ে । চুরমার
হয়েছে এ -ঘরে নিত্য যা কিছু ভঙ্গুর আর প্রগাঢ় সুর্মার
মতো অন্ধকার চোখে নেমে এসেছে আমার ভরদুপুরেই
এখন এখানে নেই , তুই নেই ; আমার বুকের মধ্যে
সবুজ পুকুর।
এইতো সেদিন আমি খাতার পাতায় মগ্ন ছিলাম একাকী
অপরাহ্ণে অক্ষরের গানে তরঙ্গিত। ' সবই ফাঁকি ' ,
কে যেন চেঁচিয়ে বলে । দেখি খুব থম্থমে সমুখে দাঁড়িয়ে
কাল- কিশোরের মতো তুই। যেন দীর্ঘ পথ নিমেষে মাড়িয়ে
এসেছিস ব'লে দিতে আমার উদ্যম সব এলোমেলো ,
দারুণ বেঠিক ।
দিচ্ছিস চক্কর তুই ঘরময় , আমিও ঘুরছি দিগ্বিদিক
জনাকীর্ণ এ - শহরে কে জানে কিসের টানে পরিনামহীন ,
বুঝলি মতিন !
যখন এখানে ছিলি , ছিলো এক ঝাঁক চিলের ক্রন্দন ঘরে ,
ছিলো তীক্ষ্ণ কলরব সকল সময় , মনে পড়ে ।
এখন আমার ঘর অত্যন্ত নীরব , যেন স্লেট , মূক , ভারি ।
কখনো চাইনি আমি নিশ্চুপ ঘর - বাড়ি ।
শতাব্দীর জন্যে- শামসুর রাহমান
শতাব্দী হঠাৎ আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে-
আচ্ছা ধরো, যদি তোমার হাত থেকে এখন
কবিতার বই ছিনিয়ে নিই,
কী করবে তুমি? তোমার মেজাজ
চৈত্রের দুপুর হয়ে যাবে নিশ্চয়। এই দ্যাখো,
কেড়ে নিলাম তোমার সাধের আধুনিক বাংলা কবিতা।
মাথা পেছনে হেলিয়ে বলি, যখন
খোদ কবিতাই আলিঙ্গনে বেঁধেছে আমাকে,
তখন কয়েকটি মুদ্রিত অক্ষর নিয়ে
কী করব আমি? অক্ষর সমুদয় উড়ে যাক মেঘমালায়।
আচ্ছা ধরো, শতাব্দী এবার আমার মুখোমুখি
দাঁড়িয়ে বলে, সমাজতন্ত্র পুরাণের পাখির মতো
ভস্মরাশি থেমে পুনরায় জ্বলজ্বলে রূপে
জেগে উঠবে কি না, এমন ভাবনায় মগ্ন তুমি আর
ঠিক সেই মুহূর্তে তোমার হাতে আমি
একটি আপেল দিয়ে বললাম, এসো আমরা দু’জন
দু’দণ্ড গল্প করি, তখন কী করবে তুমি? খুব রেগে যাবে,
তাই না? ম্লান করে দেবে আমার মুখ?
না, তেমন কিছুই হবে না, শতাব্দী। তোমার আপেলের
স্বাদ নিতে-নিতে কথা বলব ওই গহন দু’টি
চোখের দিকে তাকিয়ে, বলব লতাগুল্ম, পাখি,
নদী, নৌকোর গলুই, শস্যক্ষেত, লালনের আরশিনগর,
আর গেরুয়া বসনধারী বাউলের কথা, বলব
আমাদের ভালোবাসার কথা।
শতাব্দীর কণ্ঠ ঝরায় অপরূপ ধ্বনি-
আচ্ছা কবি, ধরা যাক, তুমি প্রস্তুত হচ্ছো
সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ বিরোধী মিছিলে
যোগ দেওয়ার জন্যে, আর সেই মুহূর্তে
আমি বললাম, কিছুতেই তোমাকে
যেতে দেবো ন। বলতে হবে, তখন কী করবে তুমি?
শোনো শতাব্দী, যদি তেমন কিছু ঘটে, তাহলে আমি
শুনব না তোমার বারণ। বরং তোমার হিরন্ময় হাত ধরে
যুগলবন্দি দীপক রাগ হয়ে পা বাড়াব
খোলা পথে, নিশ্চিত মিশে যাব ভাস্বর জনস্রোতে।
টেলিফোনে তুমি- শামসুর রাহমান
টেলিফোনে তুমি সেদিন সন্ধ্যেবেলা
কান্নায় ভেঙে পড়েছিলে প্রিয়তমা।
বুঝতে পারি নি তোমার ভেতরে কত
কত ব্যথা আর হাহাকার ছিল জমা।
তোমার হৃদয় গোলাপবাগান জেনে
ছিলাম ব্যস্ত একাকী নিজেরই মনে।
তোমার গোলাপ ছিন্ন হয়েছে শুধু
এবং আমিও বিদ্ধ কাঁটার বনে।
যে যুগে আমরা করি আজ বসবাস,
তার সন্ত্রাসে জীবনের ভিত কাঁপে।
তুমি কি কখনও দেখ নি আমার মুখ
কেমন দগ্ধ প্রাক্তন অভিশাপে?
চৌদিকে কত ভীষণ দৃশ্য দেখি,
জ্যোৎস্না রাতের প্রহরও মাতমে কাটে।
তবুও অনেক ভাঙা সেতু পার হ’য়ে
ক্যামেলিয়া হাতে বসেছি তোমার ঘাটে।
কখনও-সখনও রুক্ষ চলার পথে
ঝড়ঝাপটায় যদি ভুল হ’য়ে যায়
হয়ো না ক্রূদ্ধ অথবা হতাশাময়,
আজও তোমাকে জীবন আমার চায়।
হঠাৎ যখন মৃত্যুর ছায়া কাঁপে,
তোমার কথাই খুব বেশি ক’রে ভাবি।
যতদিন বেঁচে আছি অনিত্য ঘরে,
আমার হৃদয়ে থাকবে তোমার দাবি।
টেলিফোনে তুমি যেদিন কেঁদেছ, আমি
কুড়িয়ে নিয়েছি তোমার চোখের মোতি।
ঝ’রে-পড়া সেই অক্ষয় মোতিগুলো
আমার তিমিরে ছড়াক নিয়ত জ্যোতি।