হৃদপিণ্ড–এক ঢিবি মাটি
তার উপরে আছে খেলবার
হাড়। পাশা। হাড়।
হৃদপিণ্ড, মাটি এক ঢিবি
তার উপরে শাবল কোদাল চালাবার
অধিকার, নিবি?
হৃদপিণ্ড–এক ঢিবি মাটি
তার উপরে আছে খেলবার
হাড়। পাশা। হাড়।
হৃদপিণ্ড, মাটি এক ঢিবি
তার উপরে শাবল কোদাল চালাবার
অধিকার, নিবি?
কবিতায় কথা বলি, তা নাকি তক্ষুনি হয়ে যায়
অলংকার। তবে এই অলংকারই পরো।
এ-সজ্জা বানাতে আমার তো দিন যায় রাত যায়
বিন্দু বিন্দু রক্ত যায় ; একবার পরে দেখতে পারো
কোথায় তা ঠিকরোয় আলো, প্রসাধনে,
না তোমার হৃৎপিণ্ডে? হাজারটা কোণ
চামড়াকে আদর করে, না রক্তাক্ত পথ ধরে
হাড়ে বেঁধে? পরো, পরে দ্যাখো।
চিত্রের চেয়েও আমি চিত্রকল্প বেশি ভালোবাসি।
দিনের চেয়েও রাত্রি। রাত্রির চেয়েও বেশি চাঁদ।
ভালোবাসি সত্যের চেয়েও বেশি এমন প্রমাদ,
যার মধ্যে বিচ্ছুরিত মগ্ন স্বপ্নরাশি।
এভাবে একদা কি ভালোবেসেছিলাম তোমার অভাব?
তুমি জানো নাই, প্রিয়তমা,
তোমার চেয়েও বেশি ভালোবাসি তোমার উপমা।
--এর কোনো চারা নেই, এরকমই আমার স্বভাব।
ওগো চিত্রকল্প, তুমি এসেছিলে দশটার অফিসে,
ফলশার বেগনি মেখে, শৈশবের বলের মতন,
গিয়েছিলে হারিয়ে তারপর ঘাসের সবুজে মিশে।
সেই বলটির খোঁজে লক্ষ বছর আমি ক'রে দেবো পার,
সেই বলটির খোঁজে করবো সর্বস্ব সমর্পণ,
সেই বলটির খোঁজে পৃথিবীতে ফিরে আসতে আকাঙ্ক্ষা আবার।।
এখন তাহ'লে আমি বিনা প্রতিবাদে
সব অভিযোগগুলি মাথা উঁচু ক'রে মেনে নিয়ে
স্পষ্টত অন্তরশূন্য প্রস্তরফলক হ'য়ে যাবো |
আমি আমাদের সব প্রীতিহীনতার পাপ
নিজেই স্বীকার ক'রে নিয়ে, নিজের মণ্ডলে স'রে যাবো |
একদা নির্জন রাত্রে অকস্মাৎ শূন্য আদালতে
বিচারক. বাদীপক্ষ, উকিল, কেরানি
একজোটে চায়ের টেবিলে গোল হ'য়ে, আমাকে একেলা
নিতান্ত নিঃসঙ্গ, নগ্ন, কাঠগড়ায় তুলে
দ্বীপান্তরে ঠেলে দিয়ে, দল বেঁধে
চায়ের মজলিশে ফিরে গেলো |
যাবজ্জীবন সেই চায়ের আসরে তোমরা বন্দী হ'য়ে আছো
আমি পাল তুলে, ভেসে-ভেসে দ্বীপে চ'লে যাবো |
হৃৎপিণ্ড কোনোদিন ছিলো কি ছিলো না -
কৈফিয়ৎ অদরকারি। সব কিছু পেয়েছিলে, যা-কিছু
আমার বুকে ছিলো। বিনা প্রত্যাশায় আমি
নিরাকার প্রিয়মন্যতায় পকেট ভরিয়ে নিয়ে
এইবারে দ্বীপে চ'লে যাবো।
এই যেন সত্যি হয়, একদিন তুমি আর আমি
বাহুতে জড়ায়ে বাহু - জরাশ্লথ, দুর্বল, পান্ডুর,
নিষ্প্রভ নয়ন মেলি', অর্ধস্ফুট কম্পিত ভাষায়
উচ্চারিতে পারি যেন সমকন্ঠে 'আজো ভালোবাসি'।
এ-দেহ কুৎসিত হবে, আকুঞ্চিত কপাল কপোল,
বিস্বাদ অধর ওষ্ঠ, ন্যুব্জ দেহ, তরল-তারকা,
যৌবন ঝরিয়া যাবে, শুধু যেন থাকে যৌবনের
একমাত্র অবশিষ্ট এই কথা - 'আজো ভালোবাসি'।
সাতটি জন্ম পায়ের পরে তুলে দিচ্ছি, তুমি আমায়
মানুষ বলে ভাবলে না, ঐ সিসের মতো নরম ঠোঁটে
তেমন করে ডাকলে না ; দুই শীর্ণ হাঁটু প্যান্ট মুড়ে
অবহেলায় ক্ষয়ে যাচ্ছি অনাদরে বয়ে যাচ্ছি,
মুখের দিকে তাকালে আজ হঠাৎ কঠিন আমায় চেনা,
ডান-বাঁয়ে খাদ, সামনে খাড়াই, তোমায় খোঁজা ফুরোবে না।
যে দিকে পোড়া দুচোখ চলে, সবার মুখে ছাই দিয়ে সেই
সড়ক বেয়ে ছুট-লাগাবো। কোথায় যাবে? আমি তোমার
গায়ের গন্ধ টের পেয়ে যাই, চোখে রুমাল বাঁধলে ক'ষে
সাতশো মেয়ের ভেতর তোমার মুখ ছুঁয়ে নাম বলতে পারি।
মিছেই ভাবো চলে যাচ্ছি ; ফিরে আসবো ডাকাত হয়ে,
কপালে বুকে চোট থাকবে, পেছনে নানা ফেউ ডাকবে,
রান্নাঘরের হলুদ মাখা-হাতে আমার রক্তক্ষত
কাদামাটির মতন ছেনে বুকে তুলে রাখতে হবে।
এভাবে খেলার কোনও মানে হয় না--
তুমি যে নেশার ঘোরে উল বোনো,
চাঁদা পাও এখানে সেখানে
তারই বা কী মানে?
বেঁচে থাকা যায়, যদি ভাব হয় সমানে-সমানে।।
যে তোমাকে ছেড়ে যেতে চায়
তাকে যেতে দাও
আটকে রেখো না।
একটি কথাও না বলে তার
ব্রিফকেস গোছাতে সাহায্য করো।
প্রেসার বা থায়রয়েডের ওষুধ সে যেন
ভুল করে ফেলে না যায়। শূন্যতা ছাড়া
সে যেন ছেড়ে না যায় আর কোনো স্মৃতি।
অশ্রুগ্রন্থি থেকে যেন বেরিয়ে না আসে সূচ্যগ্র তরল
ঘুণাক্ষরেও তোমার মুখে যেন জলবসন্তের মতো
আর্তি আর হাহাকার ফুটে না ওঠে।
শুধু এগিয়ে দেওয়ার পথে নীচু স্বরে বোলো
দরজা ভেজানো থাকবে
টোকা দেওয়ার দরকার নেই।
আলতো ঠেলে দিলেই কপাট খুলে যাবে।
চাইনি, চাইনি
তবু এলো ডাইনি
বললো সে, কতোকাল
তোকে আমি পাইনি,
মনের মতন তরিযুত ক'রে খাইনি।
খাচ্ছে সে, খাচ্ছে,
বহুরূপী ভগবান নিজেকে বাঁচাচ্ছে,
স্থান-কাল-পাত্ররা সবাই পালাচ্ছে...
রেগেমেগে আমি আর নিজেকে বাঁচাইনি।
অতিক্রম করে যাওয়া শিল্পের নিয়ম
ঘুঁটের ছাপের মতো
ক্ষতচিহ্নে ছেয়ে গেছে জীবন, সময়
রক্তের জানালা ভেঙে
তবু সূর্যোকরোজ্জ্বল বাঁশি ডেকে যায়
ঝড়ের রাতের অভিসারে।
অতিক্রম করে যাওয়া
জীবনেরও নিশ্চিত নিয়ম।
পাহাড়ের চুড়োগুলো অতিক্রম করে গেছে
মেঘ।
কোনার্ক-রথের চাকা
বিংশ শতাব্দীর সীমা অতিক্রম করে চলে যায়
আরো দূর শতাব্দীর কাছে।
তুমি খুব ভালোবেসেছিলে
তুমি খুব কাছে এসেছিলে।
এখন তোমারও সৌধ ভেদ করে
চলে যেতে হবে
আরো বড় বেদনার
আরো বড় আগুনের আরতির দিকে।
সেই কবে থেকে জ্বলছি
জ্ব’লে জ্ব’লে নিভে গেছি ব’লে
তুমি দেখতে পাও নি ।
সেই কবে থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছি
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাতিস্তম্ভের মতো ভেঙে পড়েছি ব’লে
তুমি লক্ষ্য করো নি ।
সেই কবে থেকে ডাকছি
ডাকতে ডাকতে স্বরতন্ত্রি ছিঁড়ে বোবা হয়ে গেছি ব’লে
তুমি শুনতে পাও নি ‘।
সেই কবে থেকে ফুটে আছি
ফুটে ফুটে শাখা থেকে ঝ’রে গেছি ব’লে
তুমি কখনো তোলো নি ।
সেই কবে থেকে তাকিয়ে রয়েছি
তাকিয়ে তাকিয়ে অন্ধ হয়ে গেছি ব’লে
একবারো তোমাকে দেখি নি ।
তোমার দিকে তাকাই আমি দেখি অতল চোখ,
দেখি তোমার শরীর আর বুঝি তোমার মন,
এখনো খুঁজে পাইনি তার আকাঙ্ক্ষার লোক,
করুণ এক প্রতীক্ষায় শরীর ইন্ধন।
স্মরণে আসে অনেক কাল পড়েছি বিজ্ঞান,
গণিত দিয়ে বেঁধেছে নর বিপুল বিশ্বের
সকল কিছু, অথচ আজও অধরা তার প্রাণ,
অবুঝ তার শরীরে কাঁদে অজ্ঞতার জের!
শোণিত যদি ডুয়েট গায় হয় না তবে মিল।
বিশ্বজুড়ে কাটছে শুনি অজ্ঞতার তান,
অথচ পরিসংখ্যানের ঊর্ধ্বে সাবলীল
দ্বৈত কোনো সঙ্গীতের পাইনি সন্ধান।
তোমার দিকে তাকাই আমি কি যে রহস্যের
অতল এক সমুদ্রের গভীর উদ্ভাস
তোমার চোখে, শরীরে, মনে, অজ্ঞতার জের
হয়তো দেবে ব্যর্থ ক'রে সমুদ্রের শ্বাস।
৪.৭.১৯৫৭
ওই যে গোলাপ দুলছে, ও কি
ফুল না আগুন, ঠিক বুঝি না।
এগিয়ে গিয়ে পিছিয়ে আসি,
ভাবতে থাকি ধরব কি না।
ভাবতে থাকি, ঠিক কতবার
ফুলের বনে ভুল দেখেছি।
ভরদুপুরে গোলাপ ভেবে
অগ্নিশিখায় হাত রেখেছি।
গোলাপ, তুমি গোলাপ তো ঠিক?
হও যদি সেই আগুন, তবে
এই অবেলায় ফুলের খেলায়
ফের যে আমায় পুড়তে হবে।
তোমার চোখজোড়া পাঠ-অভ্যাসের মতো
পড়ে আছে আমার পড়ার টেবিলে
আমি তোমার চোখের মুখবন্ধ খুলি,
খুঁজি কাঁচল পংক্তি ভূমিকার একাগ্র শিকড় প্রণয়,
তোমার চোখ জোড়া সমুদ্র অ্যাকুরিয়াম
যেন দূর কৃষ্নবিন্দুর মাছ
ফেনায়িত সাদা ক্যানভাসের মুখ
পড়ে আছে আমার ঋজুময় ইজেলে ।
আমি তোমার চোখের রং মুখস্থ করি
তোমার চোখ জোড়া পাহাড়ের ঢালু পথ,
সমতলে গড়ে ওঠা কুঁড়েঘর, ছাতা ।
ঝর্ণার ঠোঁটে বসে থাকা শুভ্র পাথর প্রেমিক ।
আমি তোমার চোখের মুগ্ধতা মুখস্থ করি ।
তোমার চোখজোড়া লুক্কায়িত ঝিনুক-শঙ্খ
বুকে তার কান্নার গভীর সমুদ্র,
আমি তোমার চোখের শব্দ মুখস্থ করি ।
তোমার চোখ জোড়া ভোরের স্নিগ্ধ নিরবতা,
নারকেল পাতার ভুরুভঙ্গিমার বিন্দু বিন্দু শিশিরের স্বেদ ।
আমি তোমার চোখের মগ্নতা মুখস্থ করি ।
তোমার চোখজোড়া দুপারের দুটো রঙধনু, সেতু,
এপারে অপেক্ষমান মানুষের নিঃশব্দ হাঁক,
ওপারে বিশ্বাস চুমু খায় দুপারের প্রেমময় ভূমি ।
আমি তোমার চোখের সীমানা মুখস্থ করি ।