Saturday 15 August 2020

ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন- শক্তি চট্টোপাধ্যায়

একটি জীবন পোড়ে, শুধুই পোড়ে
আকাশ মেঘ বৃষ্টি এবং ঝড়
ফুলছে নদী যেন তেপান্তর
চতুর্দিকে শীতল সর্বনাশে-
পেয়েছে, যাকে পায়নি কোনোদিনও
একটি জীবন পোড়ে, কেবল পোড়ে
আর যেন তার কাজ ছিল না কোনো

এক জীবন- বিজয়া মুখোপাধ্যায়

দুপুর থেকেই সন্ধে ঘনায় ঘোর
অনন্তকাল অন্ধকারের বাস
তোমাকে সেই একটু চোখের দেখা
আমার কেন এমন সর্বনাশ

চুক্তি ছিল লিখব একজীবন
অথচ এই দীর্ঘ কঠিন শ্বাস।

Thursday 13 August 2020

হৃদয় চারণা- আবু হাসান শাহরিয়ার

মন ও হৃদয় এক নয় প্রিয়তমা,
দু'জনার আছে শিল্পিত ব্যবধান।
মন চঞ্চল---তাই শুধু তাড়াহুড়ো
হৃদয়ের আছে ঘনিভূত অভিমান।

যা কিছু মোহন, সুন্দর মনোরম---
সব কিছু নিয়ে ধনী হতে চায় মন,
যতদূরতক দৃষ্টির সীমা রেখা
ততদূর তার কাঙি ক্ষত প্রলোভন।

হৃদয়ের আছে অবিনাশী ত্যাগ, আছে
বিরহের জ্বালা, প্রাপ্তির সংবাদ
শস্যের সুখ পেতে হলে চাই তার
কঠিন মাটিতে আজীবন চাষাবাদ।

অধৈর্য মন, জানে না সে আরাধনা,
জানে না কী আছে ধ্যান ও তপস্যাতে---
ভালো লাগে যাকে তড়িঘড়ি চায় কাছে,
জানে না কী সুখ নীরব কষ্টপাতে।

হৃদয়ের আছে সুদীর্ঘ রাহাপথ,
দুঃখের সাত সমুদ্র তেরো নদী,
পরিশেষে আছে পরিণয় নির্মাণ,
যার পাহারায় চির জাগরুক বোধি।

মন পেলে তুমি খুশি হবে প্রিয়তমা?
ক্ষণিক প্রাপ্তি থাকে না---ফঙ্গবেনে।
বরং বিরহ নিয়ে চলে যাও দূরে,
পরম প্রাপ্তি তোমাকেই দেবো এনে।

নির্জন রাজহাঁস- পরিতোষ হালদার

ঝরা পাতাদেরও কিছু হাওয়াই বসন্ত থাকে....

তাই অভিমানের সাথে গাছেদের আত্মীয়তা হলে আমি বাতাসে বাসিয়ে দেবো কিছু লাল মুগ্ধতা। কারণ রোদ্দুরও জানে কান্নাদের বুকের ভেতর বাস করে এক একটি নির্জন রাজহাঁস।

দূরবীণে চোখ রাখলে আজও দীর্ঘশ্বাস আসে। তারাদের রেখায় রেখায় মায়ের ছবি---
          মা! তুমি ছিলে দীর্ঘশ্বাসের বকুলফুল।

দূরে যেতে হলে নিজের ছায়ার স্কেচ জানা জরুরি; কেননা ছায়ারা কেবল জ্যৈষ্ঠের দিকে দৌড়ায় যেখানে সে ফেলে এসেছে ---
বল্গা হরিণের মতো কিছু অন্ধকার।

সুতরাং আজও জানি না পৃথিবীর প্রথম সম্পর্কের নাম রাত্রি ছিল কি না।

চিঠি-বুদ্ধদেব গুহ

কুরচি,
তোমার চিঠি হঠাৎ এই শীতের সকালে এক রাশ উষ্ণতা বয়ে আনলো। পাতা ঝরে যাচ্ছে সামনের শালবনে, বিবাগী হচ্ছে বগি। রিক্ততার দিন আসছে সামনে। এরই মধ্যে তোমার চিঠি যৌবনের ধুতির মত এলো এক ঝাঁক টিয়ার উল্লাসিত সমস্ত সবুজ চিৎকারের মত। তার মানে এই নয় যে- তোমার চিঠি দুর্বোধ্য। উপমার খোদ ক্ষমা করে দিও। কেমন আছ তুমি? জানতে চাইলেও জানতে পাই কই?

সকাল থেকেই তোমাকে আজ খুব সুন্দর একটা চিঠি লিখতে ইচ্ছে করছিল। ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই তোমার কথা মনে পড়ছিল খুবই। আজকে ঘুম ভাঙ্গলো বড় এক চমকে। এক জোড়া পাখির ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। যে পাখিদের ডাক বড় একটা শুনিনি এদিকে। কম্বল ছেড়ে দৌড়ে বাইরে গিয়ে দেখি- এক জোড়া স্কারলেট মিনি-ভেট এসে বসেছে আম গাছের মাথায়।আমার ঘুম ভাঙ্গা নিয়ে পাখিরা- আহা রোজই যদি আসতো। আর তারপরই তোমার এই চিঠি। দিন আজকে ভালো যাবে আমার।

বলছিলাম যে, সকাল থেকেই তোমাকে সুন্দর একটি চিঠি লিখবো ভাবছিলাম। কিন্তু সুন্দর সুখের যা কিছু ইচ্ছা তা দমন করার মধ্যেও বোধহয় এক ধরনের গভীরতর সুখ নিহিত থাকে। থাকে না? আজ চিঠি লিখবোনা তোমাকে, তার বদলে একটি স্বপ্নহার পাঠাচ্ছি, লেখক কবি না তবুও তার নাম গোপন থাক। কি যে দেখেছিলাম তোমার ঐ মুখটিতে কুরচি। এত যুগ ধরে কত মুখইতো দেখলো এই পোড়া চোখ দু'টি। কিন্তু, কিন্তু এমন করে আর কোনো মুখ'এইতো আমার সর্বস্বকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করেনি। ভালো না বাসলেই ভালো... বড় কষ্ট ভালোবাসায়।

কুরচি দেখি কি করতে পারি? তোমার সাথে বেড়াতে যাবার। ইচ্ছে তো কত কিছুই করে। এই জীবনে ক'টি ইচ্ছে পূর্ণ হলো বলো? কারই'বা হয়? এমনিতে আমার অনেক কষ্ট। এমন করে ডাক পাঠিয়ে আর কষ্ট বাড়িয়ো না। একা একা মজা করতেও বিবেকে লাগে। যার বিবেক বেঁচে থাকে, তার সুখ মরে যায়। সুখী হবার সহজ উপায় বিবেকহীন হওয়া। বিবেক বিবশ হলেই বাঁচি।

ভালো থেকো
তোমার প্রিথু দা

তোমার সমীপে- কৃষ্ণা বসু

তোমাকে দিয়েছি দ্বিতীয় বাল্য, থরো থরো ছেলেবেলা ;
তোমাকে দিয়েছি ঘন অভিমানে গূঢ় গাঢ় হেলাফেলা,
তোমাকে দিয়েছি অতল সাগর পারাপারহীন আশা,
তোমাকে দিয়েছি সূচির জীবন, ভালোবাসা ভালোবাসা,
যোগ্য নই কি? তোমার চোখের মাধূর্যময় আলো,
শিরাধমনীতে পৌঁছতে চাই, প্রাণের গভীর কালো
ধুয়ে মুছে নিয়ে সফেদ সজীব হাসতেও চাই আজ,
তোমার জন্য সাজিয়ে রেখেছি প্রণয়ের কারুকাজ।

নিদ্রার নীলে ডুবে যেতে যেতে নিজেকে প্রশ্ন করি,
তোমার সমীপে তোমারই সমীপে এরকম কেন মরি?

বড় দীর্ঘ তোমাকে এই না দেখা সময়- প্রবালকুমার বসু

বড় দীর্ঘ প্রবাসে আছো, বড় দীর্ঘ তোমাকে এই না দেখা সময়
এখন শীতকাল। নিশ্চিতই গতরাতে আবারো পড়েছে বরফ
তোমার ওখানে, চতুর্দিকে তুষারপাতের নিস্তব্ধতা জানলার কাঁচে
ভিতরে বন্দী শব্দ, শব্দের ভিতরে তুমি ঘুরপাক খেয়েছ সারারাত
চিঠির শব্দমালা তুষারপাতের মত শার্সির কাঁচে লেগে গেছে
অলিন্দে কাল আর কারো পায়চারি নিশ্চিত তোমার পড়ে নি মনে
গতরাতে আমারও শব্দ সব উড়ে যেতে চেয়েছিল প্রবাসে তোমার
বড় দীর্ঘ প্রবাস এই, বড় দীর্ঘ দেখা নেই, এবং আমাদের মধ্যবর্তী শীত
প্রগাঢ় প্রবঞ্চনায় ফিরিয়ে দিয়েছে তারে, তাই বড় তীব্র অভিমানে
হয়ে আছে প্রতিটি শব্দ শুধু ভীষণ নক্ষত্র অভিমুখী

এ প্রবাস দীর্ঘ বড় এবং তোমাকে এই না দেখা সময়।।

আমি কিন্তু যামুগা- ওমর আলী

আমি কিন্তু যামুগা। আমারে যদি বেশি ঠাট্টা করো।
হুঁ, আমারে চেতাইলে তোমার লগে আমি থাকমু না।
আমারে যতই কও তোতাপাখি, চান, মণি, সোনা।
আমারে খারাপ কথা কও ক্যান, চুল টেনে ধরো।

আমারে ভ্যাংচাও ক্যান, আমি বুঝি কথা জানিনাকো।
আমার একটি কথা নিয়ে তুমি অনেক বানাও।
তুমি বড় দুষ্টু, তুমি আমারে চেতায়ে সুখ পাও,
অভিমানে কাঁদি, তুমি তখন আনন্দে হাসতে থাকো।

শোবোনা তোমার সঙ্গে, আমি শোবো অন্যখানে যেয়ে
আর এ রাইতে তুমি শুয়ে রবে একা বিছানায়,
দেখুম ক্যামন তুমি সুখী হও আমারে না পেয়ে,
না, আমি, এখনি যাইতেছি চলে অন্য কামরায়।

পারাপার- অরবিন্দ গুহ

তোমার কাছে অনেক কিছু গোপন করে রাখি,
তুমি আমার মধ্যদিনের পাখি।
অসংশয়ে শুনি তোমার নানারকম স্বর,
তুমি আমার একা থাকার ঘর।

দিনের বেলা কাটাতে হয় কটু কাজের ভানে,
দু-চোখ আমি সজল করি কপট অভিমানে।
তোমারও চোখ সহসা জলময়
সফল হল আমার অভিনয়__
মাঘের শেষে বৃষ্টি নামে বাঙলাদেশের প্রাণে।

বৃষ্টি যদি নামে মাঘের শেষে,
বলতে পার কী হয় তবে দেশে?
জান না? হায় আমিই কি তা জানি?
তুমি আমার নিরবতা, তুমি আমার বাণী।

তুমি যখন ডোবাতে চাও, আমি তখন ভাসি;
দূরে সরাও, আমি তোমার বুকের কাছে আসি।
বন্ধ হয়, আবার খোলা দ্বার।
জীবন ভরে আমার পারাপার
করতে হবে। কেন যে আমি তোমাকে ভালোবাসি!

কেন এ রকম হয়?- শামসুর রাহমান

'কেন এ রকম হয়?'
-শামসুর রাহমান।

কেন এ রকম হয়? হবে? কেন তুমি অভিমানে
স্তব্ধ হয়ে যাবে? কেন এতক্ষণ করবে না ফোন?
আমার অসুবিধে নেই, টেলিফোনও কিছু বিগড়ে আছে।
এই যে মুহূর্তগুলি, ঘণ্টাগুলি আমাকে চিবিয়ে
খাচ্ছে হিংস্র বিড়ালের মতো, তুমি কি বোঝো না? হায়,
এ বয়সে আমি আর কত কষ্ট পাব? কী আমার
অপরাধ, বুঝতে অক্ষম। গাছ হয়ে জন্মানোই
ছিল ঢের ভালো, বিষাদের লেশমাত্র থাকত না।

তোমাকে উপেক্ষা করি, এই মতো ভাবনায় তুমি
সম্প্রতি কাতর নাকি! অথচ আমি যে সারাক্ষণ
জপছি তোমাকে, এমন কী স্বপ্নের ঘোরেও করি
উচ্চারণ ভালোবাসা তোমার উদ্দেশে। আলিঙ্গনে
বাঁধি তোমাকেই মাঠে, নদীতীরে, পাহাড়ে, জঙ্গলে।
কীভাবে তোমার রোষে, প্রিয়তমা, অস্তমিত হবে?

Wednesday 12 August 2020

মেঘ- নবনীতা দেবসেন

সেই মেয়েটা, সে হতে চায় পাখি
আজকে ভাবে ঈগলপাখি হবো
কালকে ভাবে সিন্ধুসারস হই-

সেই মেয়েটা, মেয়ে ভীষণ জেদী
জেদ ধরেছে, সমুদ্র আকাশে,
দুই ডানা তার মেলবে দু'জায়গাতেই

কিন্তু আগে জল ছোঁবে না বাতাস?
ভাবতে ভাবতে নিজেই হোলো সমুদ্দুরের হাওয়া
নিজেই হোলো হাওয়ার বুকে ঢেউয়ের নোনা চুমু

সেই মেয়েটা, মেয়ে ভীষণ জেদী
শেষ অবধি জেদ রেখেছে ঠিক-
মেয়ে হয়েছে ঈশানকোণের মেঘ...

যেদিন,সেইদিন- ভাস্কর চক্রবর্তী

দিনগুলো কিলবিলিয়ে যেভাবে যাচ্ছে
মনে হচ্ছে
তেমন দিনও এবার চলে আসতে পারে
যেদিন কবিতাও আর ভালো লাগবে না
না-পড়তে, না-লিখতে।

কী করবো সেদিন? কী করবো?

আলো- প্রবুদ্ধসুন্দর কর

সন্ধ্যা নেমে এলে সমূহ মনোবেদনা নিয়ে জ্বলে ওঠে একটি নক্ষত্র
বিষাদস্পৃষ্ট তোমার মুখ
কোনো একদিন যদি স্পষ্ট হয়ে ওঠে
বোঝা যাবে, সেই নক্ষত্রের আলো
পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে, সামান্য আগে।

জয়পরাজয়- অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

তুমি আমার ভ্রূযুগ পর্যন্ত তুষার ছেয়ে দিয়ে বলেছ:
'এইবার বানাও রোদ্দুর'

আমি তোমার চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে গিয়ে
যেই জ্বেলে দিয়েছি রোদ্দুর

তোমার দু'চোখে দেখি কমনীয় ঘৃণা -
তুমি পরাজিত নাকি আমি জয়ী বুঝতে পারি না!