Wednesday 5 August 2020

ভাষা- জয়াশিস ঘোষ

ঠিক তারপর তুমি ফোঁটা ফোঁটা ঝরবে। কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলবে,
" ঘরে পথে লোকালয়ে স্রোতে জনস্রোতে আমাকে কি
একাই খুঁজেছো তুমি? আমি বুঝি তোমাকে খুঁজিনি? "
খুঁজবো। নাভির পাশে ছোট্ট তিল। ঠিক তখনই বাঁ দিকের জানলায় হিমবাহ গলে যাবে। ডান দিকে ডেকে উঠবে বসন্তবৌরি। সরে যাবে জানলায়। কপট রাগে বলবে,  'কী যে ছাই বলো?'। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ রেখে বলবো,
"জীবনে তোমাকে কোনোদিন ঠিকমতো ভালোবাসা হলো না।
শুধু হিজিবিজি ছবি, চাঁদ, মেঘ,
সবিনয় নিবেদন কাটাকুটি করে চিরদিন তোমার কাছে পৌঁছোনো।"
কেঁপে উঠবে। গলে গলে পড়বে। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা হঠাৎ আবছা হয়ে যাবে। লাল ছাতা নিয়ে হেঁটে আসবে কিশোরী। আঁচল উড়িয়ে তুমি - "এখন একটু বৃষ্টি পড়লে বেশ হত'! আমি জাদুকাঠি বের করবো। মন্ত্র উচ্চারিত  হবে-
'মেঘের কোমল করুণ দুপুর
সূর্যে আঙুল বাড়ালে-
তোমাকে বকব, ভীষণ বকব
আড়ালে ।'
ঠিক তখনই একটা ছোট্ট কালো মেঘ জানলায় উঁকি দেবে। টুকি। দুম করে একটা হাওয়া। জানলা খুলে যাবে। এক দৌড়ে পানকৌড়ি। পেছনে আমি ছুটতে ছুটতে -

'হাতের রেখায় থাকবে জানি মাইলফলক, সরাইখানা…
কৃষ্ণচূড়ার ছোট্ট চিঠি, রাধাচূড়ার বলতে মানা

বিপদ আসুক, লাগুক বাতাস, ছুটুক সময় তোমার দিকে
পাগল হওয়া বিশুই জেনো আগলে রাখে নন্দিনীকে!'

তারপর ভিজবো আশরীর। পৃথিবীর সমস্ত পুরানো অসুখ সেরে যাবে। এমন একটি স্নান, আমাদের বাঁচাবে প্রবল। একসাথে বলবো দুজনে - 'ভালোবাসি'।

বলো, কোন এক একুশে ফেব্রুয়ারি এরকম একটা দিন কাটাবে?

অবিস্মরণীয়াকে- অরণি বসু

কিছুই হয়না বলা, শুধু ছুটে আসি বারবার
বসে থাকি আর এলোমেলো কথা বলি,
*******
কত কি বলার ছিল, ভাবি একদিন ........

তোমার ওই স্তব্ধ চোখে বিস্ময় কিছুই নেই আর
তবু কাছে এসে বসে থাকি ভাবি,
তুমি কি ততটা দেবী , আমি যত পথের ভিখারী !

(কবিতাংশ)

Tuesday 4 August 2020

দিনগুলো- স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

শহর এখন বাষ্প দিয়ে মোড়া
কাচের গায়ে ভাপ লেগেছে ঠোঁটে
ট্রামের তারে নাচছে শালিখ জোড়া
তোর না-থাকা স্পষ্ট হয়ে ওঠে

কেউ থাকে না অন্ধকারের পাশে
জং-ধরা বাস একলা পড়ে ফোঁপায়
ট্রেন ধরে সব চলল বনবাসে
রাত্রিটুকু বকুল জড়ায় খোঁপায়

পথের দুপাশ জড়ায় শাড়ির পাড়ে
মেঘলা বিকেল থমকে আছে মনে
আজ কি কোথাও বৃষ্টি হতে পারে?
কেউ কি ফেটে পড়বে বিস্ফোরণে?

বুকের নীচে বারুদ বাঁধে ভুলো
কৌটো ভরে জমিয়ে রাখে গুলি...
আমার টুকরো ছড়িয়ে আছে ধূলোয়
সময় পেলে আবছা হাতে তুলিস

আমিও এখন বাষ্প দিয়ে মোড়া
ভাপ জমেছে তোর শহরের হাতে
কে জানে কার জন্য জীবনঝোরা
কাটিয়ে দিল অঝোর বৃষ্টিপাতে!

সিল্যুয়েট ৭- জয়াশিস ঘোষ

ফেরার সময় বৃষ্টি নামে। বুকের মধ্যে ব্যক্তিগত মূর্ছনা
তুমি পড়ে ফেলেছ পাশবালিশ? অলিখিত ঝরনা?
*****
আমাদের
চটিপথ পলি জমে গুহা হয়ে গেছে।  তার মধ্যে
স্ফটিক খুঁজেছ তুমি, পীচরঙা বিকেলের জ্বর?

আমাদের ঠোঁট থেকে কথা তুলে নাও,  ঈশ্বর...

(কবিতাংশ)

Monday 3 August 2020

লুডো- জয়াশিস ঘোষ

কিছু একটা বলবে বলে
তুমি তার পেছনে ধাওয়া করেছ দূর

সে প্রতিটা বাঁক ঘোরার মুখে
তোমার দিকে তাকিয়ে  হাসছে
ভ্রূ ভঙ্গিতে করছে ভাঙচুর

তুমি দৌড়াচ্ছ, ছুঁয়ে ফেলার আগেই
সে মোড় ঘুরছে, ভাঙছে ঢেউ

শেষ প্রান্তে এসে দেখলে
যে কথা বলবে বলে খুঁজেছিলে

তার বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে
সে কথাটা বলে গেছে অন্য কেউ...


হত্যাকারী জানে
এই মূহুর্তে আলো পছন্দ করছ তুমি

তোমার আলোকে শেখাওনি জিততে গেলে
                              অন্ধকার ভালোবাসতে হয়

(কবিতাংশ)

বর্ষশেষ- অরণি বসু

আরো একটা বছর শেষ হয়ে গেলো।
বছরের প্রথম দিনে যে নীল সোয়েটারটা পরেছিলুম
বছরের শেষ দিনেও আমি সেটাই পরে আছি।

গায়ের রং হয়তো একটু উজ্জ্বল হয়েছে আমার, আর
কমে গেছে কোলাহলপ্রিয়তা।
অনেক অপছন্দের ব্যাপারও আমি এখন সহজে মেনে নিতে পারি,
একা একা রাস্তায় হাঁটার সময় আমি আর গান গাই না।

আরো একটা বছর কেটে গেলো, সারা বছরের
টুকরো টুকরো অপমানের ধারাবাহিক ছবি ভেসে আসছে মনে।
প্রোজেক্টারে ফাঁকা রীল ঘোরার মতো
কিরকিরে অবসাদ চারিদিকে।

তোমার কি মনে আছে, বছরের প্রথম দিনে
আমি তোমায় বলেছিলুম, আমার আর বাঁচতে ভালো লাগে না।
বছরের শেষ দিনে সেই কথাটাই একটু ফিরিয়ে বলতে চাই,
                                   আমি ঘৃণা করি আমার বেঁচে থাকাকে।

সিল্যুয়েট ৩- জয়াশিস ঘোষ

এসব বর্ষাদিনে তুমি আমাকে ভেঙে দেবে। গোপনে
প্যান্ডোরার বাক্স খুলে উড়িয়ে দেবে রঙীন প্রজাপতি।
আমি কাঁদতেও পারবো না। কান্না শেখায়নি কেউ।
তবু আমার জানলা খুলে খুলে যায়। তুমি খুলে দাও
বেহেস্তের ক্লিপ। ভয় হয়, যদি এভাবেই বাঁধ ভেঙে যায়
যদি বুকে উঠে আসে বন্যার জল? তোমার জিভের নীচে
আমার অসমাপ্ত ঘরবাড়ি ভেসে আসে? চিঠি শেষ
এখন তোমার কাছে আমি মানে শাপলার ফুল
যেখানে জল জমে কান্না হয়নি কখনো

একটা বেড়াল শুধু বসে আছে ভেজা কার্নিশে.....

মেঘ ডাকছে- শক্তি চট্টোপাধ‍্যায়

মেঘ ডাকছে ডাকুক
আমার কাছেই থাকুক
ভালো থাকবো, সুখে থাকবো-- এই বাসনা রাখুক।

কষ্ট হয়তো একটু হবে, এই তো ছিরির ঘর
আমার কাছে অল্প সময় বাইরে অতঃপর--
বৃষ্টি ভালো লাগছে যখন, পদ্মপাতায় রাখুক।

ওইটুকু তো মেয়ে
ছোট্ট আমার চেয়ে
এতোই যদি লজ্জা তাহার, দু হাতে মুখ ঢাকুক
আমার কাছে থাকুক, তবু আমার কাছে থাকুক।

Sunday 2 August 2020

দায়মোচন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

চিরকাল রবে মোর প্রেমের কাঙাল,
          এ কথা বলিতে চাও বোলো।
এই ক্ষণটুকু হোক সেই চিরকাল;
          তার পরে যদি তুমি ভোলো
মনে করাব না আমি শপথ তোমার,
আসা যাওয়া দুদিকেই খোলা রবে দ্বার,
যাবার সময় হলে যেয়ো সহজেই,
          আবার আসিতে হয় এসো।
সংশয় যদি রয় তাহে ক্ষতি নেই,
          তবু ভালোবাসো যদি বেসো।
বন্ধু, তোমার পথ সম্মুখে জানি,
          পশ্চাতে আমি আছি বাঁধা।
অশ্রুনয়নে বৃথা শিরে কর হানি
          যাত্রায় নাহি দিব বাধা।
আমি তব জীবনের লক্ষ্য তো নহি,
ভুলিতে ভুলিতে যাবে হে চিরবিরহী;
তোমার যা দান তাহা রহিবে নবীন
          আমার স্মৃতির আঁখিজলে,
আমার যা দান সেও জেনো চিরদিন
          রবে তব বিস্মৃতিতলে।
দূরে চলে যেতে যেতে দ্বিধা করি মনে
          যদি কভু চেয়ে দেখ ফিরে
হয়তো দেখিবে আমি শূন্য শয়নে
          নয়ন সিক্ত আঁখিনীরে।
মার্জনা করো যদি পাব তবে বল,
করুণা করিলে নাহি ঘোচে আঁখিজল,
সত্য যা দিয়েছিলে থাক্‌ মোর তাই,
          দিবে লাজ তার বেশি দিলে।
দুঃখ বাঁচাতে যদি কোনোমতে চাই
          দুঃখের মূল্য না মিলে।
দুর্বল ম্লান করে নিজ অধিকার
          বরমাল্যের অপমানে।
যে পারে সহজে নিতে যোগ্য সে তার,
          চেয়ে নিতে সে কভু না জানে।
প্রেমেরে বাড়াতে গিয়ে মিশাব না ফাঁকি,
সীমারে মানিয়া তার মর্যাদা রাখি,
যা পেয়েছি সেই মোর অক্ষয় ধন,
          যা পাই নি বড়ো সেই নয়।
চিত্ত ভরিয়া রবে ক্ষণিক মিলন
          চিরবিচ্ছেদ করি জয়।

Saturday 1 August 2020

কোথায় পাব তারে- কালকূট

'...একটা কথা জানতে ইচ্ছে করে ৷'
'বলো ৷'
'মনে থাকবে, আমাকে ?'
'থাকবে ৷'
'...তবে, আর একটা কথা ৷'
'... বলো ৷'
'মনে থাকুক না থাকুক, আমি বলি, একটু মনে রেখো ৷'

Tuesday 28 July 2020

রচি মম ফাল্গুনী- জয়াশিস ঘোষ

চোখ ফেরাতে পারিনি

মিনিবাসে চলে গেছে বিকেল
দুটো ফিঙে জাপটাজাপটি করে
গুছিয়ে নিয়েছে সংসার

তার মধ্যে এক বিন্দু জল
স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে তোমার কপালে
যে আলো অন্ধ করে দেয়
                           আমি তার কাছে ঋণী

সে আলোয় দেখেছি তোমার
উপেক্ষা কতটা নরম হতে পারে
                                         বৃষ্টি নামলে

উঠোনে জমেছে জল
আমার চোখের উপরে পা রেখে
হেঁটে যাও অতল
                 আশ্চর্য মিনিবাসের দিকে

চোখের কথা আর কে শুনেছে কোথায়
এক উঠোনে এত জল আটকে রাখা যায়!

শান্তি- জয় গোস্বামী

কত কাছে এসেছিলে। অত কাছে এসে
সরে যাওয়া শক্ত, এ বয়সে।

কিন্তু সরে যাওয়াই নিয়তি।

চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে ছুরি খুলে নেওয়ার পরেও
আগুন কি ফোয়ারা চায় না? তখনও থর থর কেঁপে চলে
পাহাড় ঘুমন্ত আজ। ঢালু সূর্য। ছায়া পড়ছে জলে।

আগুন কি সম্পূর্ণ নেভে? দু-জনে জলের ধারে এলেই এখনও
তলা থেকে দেখা দেয় রক্তরঙ আভাতাপ--- ঘাটের পাষাণে
ধাক্কা দেয়, কিছুই না বুঝতে-চাওয়া ঢেউ

আবার কী লাভ তাতে? দমবন্ধ তাপ চেপে রেখে
কত পরিকল্পনায় আবার দু-জনে একলা হওয়া
কয়েক মুহূর্ত যেন কয়েক ঘণ্টার অবসান
দু-জন দু-জনকে শুধু মরিয়ার মতো ছেঁড়াখোড়া

আবার ক্লান্তির পর ক্লান্তি আর অনুতাপ
                              ঘাট থেকে ফিরে যাওয়া ঢেউ

এত যদি লুকোছাপা করলাম দু-জনে
বলো, শান্তি পেলাম কি দু-জনের কেউ ?

বোকা মানুষের চিঠি ৬- জয়াশিস ঘোষ

কিছুটা অংক মিলে যায়, কিছুটা দিন পাগলাটে
কষ্ট জমাট হলে শীত প্রবল শব্দ করে ফাটে

কিছুটা তোমার ঘুড়ি কাটে, কিছুটা আমার বলিরেখা
ঠিকানা পালটে ফেলে লোক, বিয়োগফলের থেকে শেখা

চোখের পশম ছুঁড়ে ফেলো। বাতিল পুরানো সোয়েটার
ট্রেনের কামরা খালি হলে ভীষণ কান্না পাবে তার

কান্নায় কী বা যায় আসে! শীতের আগুন মাপা শোক
জড়িয়ে ধরবে বলে তুমি এখনও বিষাদ ভালোবাসো

ভালোবেসে ফিরে আসো তুমি। জানালায় জমে যায় ঝুল
শীতের কুয়াশা জানে শুধু রোদের আদর ছিল ভুল!

পুরী, ২০১০- অরণি বসু

আবার এসে দাঁড়িয়েছি তোমার সামনে-
আবার অন্ধকার, অন্ধকারে ফসফরাসের দাঁত,
আমিষ গন্ধ, ফেরিওয়ালাদের হাতছানি।
আবার এসে দাঁড়িয়েছি তোমার সামনে
একা, পরিত্রাণহারা।

গোপন ক্ষত, মায়া, অসহায় উদাসীনতা, জগন্নাথ।
ঝাঁপ বন্ধ করে কেউ কেউ আগুন জ্বালিয়েছে
সেই আগুন থেকে আমি উত্তাপ শুষে নিই।

বার বার ফিরে আসি, আসতেই হয়,
ঝিনুকে পা কাটলে সহজে সারে না।