Monday 10 August 2020

কোথাও কেউ-তসলিমা নাসরিন

কোথাও না কোথাও বসে ভাবছো আমাকে, আমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তোমার,
মনে মনে আমাকে দেখছো, কথা বলছো,
হাঁটছো আমার সঙ্গে, হাত ধরছো,
হাসছো।
এমন যখন ভাবি, এত একা আমি, আমার একা লাগে না,
ঘাসগুলোকে আগের চেয়ে আরও সবুজ লাগে,
গোলাপকে আরও লাল,
স্যাঁতস্যাঁতে দিনগুলোকেও মনে হয় ঝলমলে,
কোথাও না কোথাও আমার জন্য কেউ আছে
এই ভাবনাটি আমাকে নির্ভাবনা দেয়,
ঘোর কালো দিনগুলোয় আলো দেয়,
আর যখন ওপরে ওপরে দেখাই যে পায়ের তলায় খুব মাটি আছে,
আসলে নেই, আসলে পা তলিয়ে যাচ্ছে, তখন মাটি দেয়।
যখন মনে হয় ভীষণ এক ঝড়ো হাওয়ায় উল্টে যাচ্ছি, যেন একশ শকুন আমার দিকে উড়ে
আসছে, হিংস্র হিংস্র মানুষ দৌড়ে আসছে আমাকে খুবলে খাবে — অসহায় আমিটিকে
ভাবনাটি নিরাপত্তা দেয়।
কেউ ফিরে তাকায় না, কেউ স্পর্শ করে না, ভালোবাসে না
দেখেও আমি যে ভেঙে পড়ি না, আমি যে ভেসে যাই না, আমি যে কেঁদে ভাসাই না–
সে তো তোমার কারণেই, কোথাও না কোথাও তুমি আছো বলে।
আছো, কোথাও আছো
যে কোনওদিন আমি ইচ্ছে করলে তোমাকে পেতে পারি,
এই ভাবনাটি তোমার কাছ থেকে দূরে রাখতে পারছে আমাকে,
আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারছে।

কাব্যগ্রন্থ ঃ কিছুক্ষণ থাকো

দ্বিধাগ্রস্ত অধিবাস- রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

পলেস্তারা খ'সে পড়া এই ঘরের দেয়াল, এইসব আসবাব
                                    এতো পরিচিত কেন!

কোনোদিন কি এখানে ছিলাম কোনো জন্মে
আমার অস্তিত্বকে ভালোবেসে কারো বিনিদ্র রাত কেটে যেতো
ললাটে আমার চুম্বন এঁকে কারো শুরু হতো প্রথম সকাল।
কোনোদিন কি আমার না-থাকায় কেউ এসে ছড়াতো বিলাপ
                                        নিশব্দ বাতাসের মতো---

(কবিতাংশ)
৩১.০৭.৭৬ (রাত্রি) মিঠেখালি মোংলা

ব্যথা দাও, বুকে রাখবো- রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ


ব্যথা দাও, বুকে রাখবো
ব্যথার জন্যই তো হৃদয়
আঘাতে বুক ভাঙবে না
বুকে ব্যথা আছে ।

গলিত লাভাগুলো বেদনার
যেন ঘনীভূত পাথরের দেহ
আঘাতে পাথর কখনো গলে না
গলে না হৃদয় ।

পাহাড়ে ধস নামলে কখনো
মাটি অনায়াসে পেতে দেয় বুক ।
তুমি যাবতীয় দুঃখকে ছুঁড়ে দাও
আমি বুক পেতে নেবো
বুক ভাঙবে না ।

দুয়ার বন্ধ করলেই
আমি ফিরে যাবো নির্বিকার,
অস্বীকার করো মেনে নেবো ।

এলবামে স্মৃতি নেই বলে
আদৌ দুঃখ করি না,
সোনালি নিঃসঙ্গতায় আমার
বিচিত্র দুঃখের সমাবেশ সঞ্চয় - ।

ব্যথা দাও, বুকে রাখবো
ব্যথায় ভাঙবে না বুক
বুকে ব্যথা আছে ।

চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয় -রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে
আমার না-থাকা জুড়ে।

জানি চরম সত্যের কাছে নত হতে হয় সবাইকে-
জীবন সুন্দর
আকাশ-বাতাস পাহাড়-সমুদ্র
সবুজ বনানী ঘেরা প্রকৃতি সুন্দর
আর সবচেয়ে সুন্দর এই বেঁচে থাকা
তবুও কি আজীবন বেঁচে থাকা যায়!
বিদায়ের সেহনাই বাজে
নিয়ে যাবার পালকি এসে দাঁড়ায় দুয়ারে
সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে
এই যে বেঁচে ছিলাম
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে যেতে হয়
সবাইকে
অজানা গন্তব্যে
হঠাৎ ডেকে ওঠে নাম না জানা পাখি
অজান্তেই চমকে ওঠি
জীবন, ফুরালো নাকি!
এমনি করে সবাই যাবে, যেতে হবে।

প্রত্যাবর্তন- নির্মলেন্দু গুণ

যারা সমুদ্রের গর্জন থেকে মানুষের কান্নাকে পৃথক করতে পারে
তারাই শুনুক, আমি শুনতে চাই না ভেসে-আসা মহাসিন্ধুর গান।
যারা বৃষ্টিপাত থেকে মানুষের অশ্রুপাতকে পৃথক করতে পারে,
তারাই বৃষ্টির সৌন্দর্য দেখুক; তাদের স্বপ্নের মধ্যে বর্ষিত হোক
সুরাবৃষ্টি, তারাই কণ্ঠভরে পান করুক মদ। মাদকতার মধ্যে
আমি ভুলতে চাই না আমার বাস্তবতার দুঃখ।

যারা সুন্দরী নারীর সঙ্গে অভিনয় করতে পারে ভালোবাসার,
প্রলম্বিত হোক তাদের যৌবন। দীর্ঘস্থায়ী হোক তাদের সঙ্গম।
আমি আমার যৌবনকে গুটিয়ে নিয়েছি অভ্যন্তরে, রেশমের মতো।

(কবিতাংশ)

আসমানী প্রেম- নির্মলেন্দু গুণ

নেই তবু যা আছের মতো দেখায়
আমরা তাকে আকাশ বলে ডাকি,
সেই আকাশে যাহারা নাম লেখায়
তাদের ভাগ্যে অনিবার্য ফাঁকি !

জেনেও ভালোবেসেছিলাম তারে ,
ধৈর্য ধরে বিরহ ভার স'বো ;
দিনের আলোয় দেখাবো নিষ্প্রভ
জ্বলবো বলে রাতের অন্ধকারে ।

আমায় তুমি যতোই ঠেলো দূরে
মহাকাশের নিয়ম কোথায় যাবে ?
আমি ফিরে আসবো ঘুরে ঘুরে
গ্রহ হলে উপগ্রহে পাবে !

মাটি হলে পাবে শস্য- বীজে
বাতাস হলে পাবে আমায় ঝড়ে !
মৃত্যু হলে বুঝবে আমি কি যে ,
ছিলেম তোমার সারাজীবন ধরে !

Sunday 9 August 2020

নবধারা জলে ১- উৎপলকুমার বসু

মন মানে না বৃষ্টি হল এত
সমস্ত রাত ডুবো নদীর পাড়ে
আমি তোমার স্বপ্নে-পাওয়া আঙুল
স্পর্শ করি জলের অধিকারে।

এখন এক ঢেউ দোলানো ফুলে
ভাবনাহীন বৃত্ত ঘিরে রাখে--
স্রোতের মতো স্রোতস্বিনী তুমি
যা-কিছু টানো প্রবল দুর্বিপাকে

তাদের জয় শঙ্কাহীন এত,
মন মানে না সহজ কোনো জলে
চিরদিনের নদী চলুক, পাখি।
একটি নৌকো পারাপারের ছলে

(কবিতাংশ)

রৌদ্রে- বিনয় মজুমদার

পৃথিবীর কাজে ব্যস্ত, ভিজে মুখ দুপুরের ঘামে;
আকাশ রয়েছে ভ'রে নীল রৌদ্রে,
শরীরের দীপ্তি তার ক্লান্ত হয়ে আছে ৷
ক্লান্ত হয়ে অবসরে— ক্ষণিক বিশ্রামে
চেয়ে থাকে বহু দূরে— বহু দূরে ঘুরে আসে অলস মেঘের কাছে কাছে,
জেগে থাকা অবসরে নয়—
একদিন চুপি চুপি কাছে যদি যেতে পারি
                                         জ্যোৎস্নার নিচে তার ঘুমের সময় !

কােনোদিন বলেনি সে পৃথিবীর সেই মৃদু পুরাতন কথা৷
একটি মানুষ আর মানুষের জীবনের—হৃদয়ের অপরূপ পরিপূরকতা
মনে ক'রে কােনােদিন ডাকবে না সে কি কোনো
                               মানুষকে—নেবে নাকি বেছে?
হয়তো অনেক বার ডেকেছে স্বপ্নের মাঝে
কেবল ঘুমের ঘোরে ডাকে সে,ডেকেছে I
একদিন চুপি চুপি কাছে যদি যেতে পারি জেগে থাকা অবসরে নয়—
জ্যোৎস্নার নিচে তার ঘুমের সময়!

বিনয় মজুমদার- তরুণ বন্দোপাধ্যায়

************************
স্মৃতির মতো রহস্যময় তিনি,
বীজের মতো ব্যাকুল দুটি চোখ
মেলে অাছেন,সামনে পড়ে অাছে
কান্না,ধুলো,অাকাশ : বিশ্বলোক।

কত-কিছুই দেখে গেলেন তিনি
অবাক করার,স্তব্ধ করার মতো,
অন্যে পেল জ্বরে শীতল প্রলেপ,
তিনি পেলেন জীবন-ভরা ক্ষত !

জীবন সে তো মৃত্যুরই হাত ধরে
অনন্তকে স্পর্শ করে থাকা,
তবু অাকাশ,একটা কথা রাখো :
ফিরিয়ে দাও কবিকে তাঁর চাকা।

(কবিতাংশ)

Saturday 8 August 2020

প্রজাপতি- বিনয় মজুমদার

হয়তো আলোর ভয়ে হয়তো বা লাজে
পৃথিবীর কাছ থেকে, নিজের দু'চোখ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে
রেশমের প্রজাপতি কতোকাল একাএকা এখনো রয়েছে প'ড়ে রেশমের মাঝে।

দেখি আর কতো দিন ভাবি,
একদিন এই বেশ ছিঁড়ে ফেলবে সে,
খেলবে সে উদ্দাম আলোকের দেশে।
প্রতিদিন দেখি আর ভাবি,
লাল-নীল ফুলদের পরিবেশে পাখা মেলে প্রখর বাতাস খেয়ে দ্রুত নাচবে সে।

বহুদিন হলো সে তো ছাড়ে না এ-বাসা, আর
হয় না সে নিজে চমকিত।
অবরোধে থেকে থেকে প্রজাপতি অবশেষে ম'রে যায়নি তো!

এখন ওসব কথা থাক- মণীন্দ্র গুপ্ত

এক লক্ষ বছর সঙ্গে থাকার পর সাব্যস্ত হবে, তুমি আমার কিনা।
ওসব কথা এখন থাক।
এখন চলো মিকির পাহাড়ে বুনো কুল পেকেছে,
                                                   চলো খেয়ে আসি।

লাল রুখু চুল
               সূর্যাস্তের মধ্যে
অর্কিডের উজ্জ্বল শিকড়ের মতো উড়ছে।
—দেখি দেখি, তোমার তামাটে মুখখানা দেখি।

সূর্য এখনি অস্ত যাবে। পশুর মতো ক্ষীণ শরীরে
আমরা হাঁটু পর্যন্ত জলস্রোত পেরিয়ে চলেছি—
                                      জলস্রোত ক্রমশ তীব্র... কনকনে...

বাঁশিওয়ালা- জয়াশিস ঘোষ

যারা বৃষ্টি হলে বাইরে আসে সমুদ্র দেয় পাড়ি
খোয়াবনামা চোখের পাতা বিষণ্ণতায় ভারী

যারা হাতের মুঠোয় লুকিয়ে রাখে একটুখানি বালি
ধরতে গেলে আকাশ দেখে খুললে মুঠো খালি

যারা হঠাৎ হঠাৎ প্রেমে পড়ে পা থেমে যায় মোড়ে
ঘুমের ভেতর একটা বিড়াল অবিন্যস্ত ঘোরে

যারা গুছিয়ে রাখে ঘরের কোণ আর ছাদে ফুলের টবও
অতীত থেকে কুড়িয়ে আনে বরফ পড়ার খবর

যাদের ঠোঁট ফুলালে মেঘলা আকাশ হাওয়ায় ওড়ে পাতা
কান্না পেলে উড়িয়ে দেয় বিষাদ ও কলকাতা

যাদের কেউ থাকে না জ্বরের রাতে কপাল থেকে নদী
চোখ বুজলে আলাদিনের প্রদীপ মেলে যদি

যারা নিজের ভেতর লুকিয়ে পড়ে সন্ধে এলে নেমে
একলা ছাদে বৃষ্টি মাখে নিজেই নিজের প্রেমে

যাদের কেউ রাখেনি কপালে ঠোঁট, বলেনি 'ভালোবাসি'
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তারাই বাজায় বাঁশি...

বন্ধুকে- অরণি বসু

কাল রাতে অনেকদিন পর তোমাকে আবার স্বপ্নে দেখলুম।
দেখলুম, এক বিশাল হলঘরে সার সার লোকের সঙ্গে
তুমি বসে আছো, আমিও। একটু তেরছাভাবে মুখোমুখি।
সবাই কথা বলছে সবার সঙ্গে, কুশল বিনিময় করছে, আর
সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে উড়ে এসে লাল নীল পরীরা
হাতে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে কাগজের কফিপাত্র।
শুধু আমরাই কোনো কথা বলছিলুম না।
আমি মাঝে মাঝে চোখ তুলে দেখছিলুম, তুমি
                              কখনো কটমট করে তাকিয়ে আছো আমার দিকে,
                              কখনো চোখ থেকে সরিয়ে নিচ্ছো চোখ।

প্রথম প্রথম মজা লাগছিলো খুব ;
প্রথম প্রথম মনে হচ্ছিলো এ-ও তো আরেক রকম খেলা।
তারপর হঠাৎ কখন, কেন, কিভাবে জানি না আমার মাথায়
জমে উঠলো মেঘ, মেঘ নেমে এসে ভিজিয়ে দিলো চোখ।
সার সার লোকের মধ্যে একদম একা, আমি,
রুমাল বার করে, চোখ ঢেকে বসে রইলুম।

অনেকক্ষণ পর, চোখ খুলতেই দেখি সব ভোঁ ভোঁ।
কোথায় লোকজন, কোথায় পরী আর তুমিই বা কোথায়!
নিজের ঘরে আয়নার সামনে বসে আমি একা-একা
কাঁদছি, কাঁদছি, কেঁদেই চলেছি।

শিলালিপি- গৌতম গুহ রায়

পাহাড়ে বেড়াতে গেলে যার শিলালিপির কথা মনে পড়ে
তাকে ভালোবাসবে বলে মেয়েটি জাদুঘর হল

তার হাতে পায়ে কষ্টিপাথরের কারুকাজ
তার মুখে রতিপাথরের উল্লাস
যুবকটির খোঁজে পাহাড়ের খাঁজে
লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে জাদুঘর

পাহাড়ি ঝরনা দিয়ে বহে আসে প্রস্তরখণ্ড
অগ্নিস্তন....মন্ত্র খচিত তাতে....
শোনা যায়, পিকনিক - পাগল যুবকেরা
শিলালিপির মন্ত্রে চিঠি লেখে
                             তাদের যুবতীদের -

মন্ত্রস্পর্শে জেগে ওঠে অনন্ত অগ্নিতাপ